Thursday, November 13, 2014

শানে মহিউদ্দিন ৩য় সংখা




নূরুল ইরফান ফি তাফসীরিল কুরআন-৩
ড. মাওলানা এ কে এম মাহবুবুর রহমান
অধ্যক্ষ, ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদরাসা, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন

بسم الله الرحمن الرحیم
اقرأ باسم ربك الذی خلق- خلق الانسان من علق- اقرأ وربك الاکرم- الذى علم بالقلم- علم الانسان ما لم یعلم
“পড়ুন আপনার রবকে চেনার জন্য যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাটবদ্ধ রক্ত থেকে পড়ুন আপনার রবকে যে মহা মহিম, যিনি শিক্ষা দিচ্ছেন কলমের মাধ্যমে, শিক্ষা দিচ্ছেন মানুষকে যা সে জানতো না। ”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনা মতে, কুরআন মাজীদের সর্ব প্রথম নাযিল হয় উপরোক্ত পাঁচটি আয়াত।
সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ সূরা ‘আল ফাতেহা’ (الفاتحة)
তিন বছর বিরতির পর সর্বপ্রথম নাযিলকৃত পূর্ণাঙ্গ সূরা ‘আল মুদ্দাসসির’:
يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ (১) قُمْ فَأَنْذِرْ (২) وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ (৩)
এখন প্রশ্ন হল, এ কুরআন যাকে পড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা কেমন গ্রন্থ? তার লক্ষ্য কী? এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে জানা দরকার। জবাবে সংক্ষেপে বলা যায়- আল কুরআন কালোত্তীর্ণ, অবিনশ্বর, চিরন্তণ- সন্দেহাতীত গ্রন্থ। যুগ জিজ্ঞাসার উৎকর্ষতা বিধানে, সমকালীন চাহিদা পূরণে, জ্ঞানের আধুনিকতায় এক অনন্য গ্রন্থ। এ মহাগ্রন্থ সু-দীর্ঘ ২২ বছর ৫ মাস ১৪ দিনে নাযিল হয়েছে। যার প্রতিটি আয়াত মানব-দানব ও ¯্রষ্টার মাঝে অন্যতম সেতুবন্ধন। ঈমানের বলে বলিয়ান হয়ে ইসলামের সৌন্দর্য্যে জীবনের সকল ক্ষেত্রকে সু-সজ্জ্বিত করে ইহসানের বাহনে মানুষ আল্লাহর কুরবত তথা নৈকট্য লাভ করবে এটাই আল কুরআন নাযিলের প্রধান লক্ষ্য। পার্থিব জীবনে কালেমা তাইয়্যেবার বাস্তবায়নের মাধ্যমে হায়াতে তাইয়্যেবা তথা পূত:পবিত্র, সর্বাধুনিক, সদা সতেজ, প্রগতিশীল, সমৃদ্ধ ও শান্তিময় জীবন লাভ করবে। আর পরকালীন জীবনে জান্নাত লাভ করে প্রিয়তম মনিব-মালিক, রহমান-রহীম রাব্বুল আলামীনের দিদারে ধন্য হবে এটাই তো মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে।
এখন প্রশ্ন হলো- প্রথম শব্দ ‘اقرأ’ (ইকরা) তথা পড়–ন দিয়ে শুরু হল কেন? ‘اسمع’ (ইসমা’) শুনুন, বা ‘اعلم’ (ই’লাম) জানুন বলা হয়নি কেন? এ শব্দ সু স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে এ মহাগ্রন্থ জ্ঞান-বিজ্ঞানের মহা সাগরের অনন্য বিশ্বকোষ। এ কুলকিনারাহীন মহা সমুদ্র মন্থন করে মুক্তো আহরণ করতে হলে পড়ো, পড়ো এবং পড়ো। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে হবে। কুরআনের প্রতি ঈমান রাখে, কুরআনকে পবিত্র মনে করে, চুমো খায়, আদর করে, এসবের সাথে যতক্ষণ সহী তিলাওয়াত করতে না পারে, তরজমা না বুঝে, এ কুরআনে কি বলা হয়েছে, সে অনুযায়ী কি করণীয়-কি বর্জনীয় তা হৃদয়ঙ্গম করতে না পারলে ‘কিরাআত’ হয় না। কিরাআত অর্থ যা পড়বে তা সহী করে পড়বে, যা পড়বে তা বুঝবে। তাইতো প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জ্ঞান অর্জন কে ফরয দায়িত্ব হিসেবে পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে:-
طلب العلم فريضة على كل مسلم (سنن ابن ماجه)
“প্রত্যেক মুসলিমের (নর-নারী) উপর ইলম অর্জন ফরয।” (সুনানে ইবনে মাযাহ)
এখন প্রশ্ন হলো কোন ইলম অর্জন করা ফরয? এর জবাব পাওয়া যায় অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের জ্ঞানের অধিকারী প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র বাণীতে তিনি এরশাদ করেন:
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ ্র الْعِلْمُ ثَلاَثَةٌ وَمَا سِوَى ذَلِكَ فَهُوَ فَضْلٌ آيَةٌ مُحْكَمَةٌ أَوْ سُنَّةٌ قَائِمَةٌ أَوْ فَرِيضَةٌ عَادِلَة- (سنن ابى داود- (৩/৭৮
“তিন প্রকার ইলম অর্জন করতে হবে, এর বাইরে যা ইলম তা মর্যাদার বাহন। আর তা হলো সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ, সুপ্রতিষ্ঠিত সুন্নাত ও ভারসাম্যপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জ্ঞান।” (সুনানু আবি দাঊদ-৩/৭৮)
কিরাআত অর্থ লিখিত পান্ডুলিপি দেখে দেখে পড়া। হযরত জীবরাঈল আলাইহিস সালাম রেশমী কাপড়ে সোনালী অক্ষরে লেখা পবিত্র কুরআনের প্রথম পাঁচ আয়াত সামনে ধরে বললেন- ‘اقرأ’ (ইকরা) তথা   পড়–ন। যেমন বর্ণিত হয়েছে:
عن جابر رضي الله عنه : أن النبي صلى الله عليه و سلم كان بحراء إذ أتاه الملك بنمط من ديباج فيه مكتوب : { اقرأ باسم ربك الذي خلق } إلى { ما لم يعلم- (المستدرك على الصحيحين للحاكم -২ / ৫৭৭)
“হযরত জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্নিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেরা গুহায় অবস্থান করছিলেন, হঠাৎ ফেরেশতা রেশমী কাপড়ের লেখা নিয়ে আসলেন তাতে লেখা ছিল .. .. اقرأ باسم ربك الذي خلق } إلى { ما لم يعلم” (আল মুসতাদরাক-২/৫৭৭) এখন প্রশ্ন হল সর্বকালের সর্বোচ্চ সাহিত্য, দর্শন ও এরফানের সর্বোচ্চ মাকামে অধিষ্ঠিত এ খোদায়ী বাণী লিখিত আকারে এমন একজন মহান ব্যক্তির কাছে প্রেরিত হল যিনি কোনদিন কোন মাদরাসা-স্কুল-কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাননি, জীবনে কোন শিক্ষকের কাছে মূহর্তের জন্য সময় দেননি। তাঁর সামনে লিখিত ডকুমেন্ট উপস্থাপনের রহস্য কী? জবাবে বলা যায়, ইকরা শব্দ শোনার আগেই তাঁর কলব মুবারকে بسم اللہ الرحمن الر حیم এর নূরাণী চ্যানেল ওপেন হয়ে গেছে যাতে গোটা কুরআন মজীদ তাঁর কলবের মেমোরী সেলে গ্রথিত হয়ে অন্তরের অন্ত:স্থলে কম্পন শুরু হয়ে যায়। তাঁর ফুয়াদ এক জ্বালওয়াতেই লৌহ মাহফুজের কুরআন রিসিভ করে। ইমামে আযম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর রূহানী জগতের মহান মোর্শেদ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের মহান ভান্ডার হযরত ইমাম জাফর সাদেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাইতো বলেছেন ‘আল কুরআন’ হচ্ছে সকল ঐশী গ্রন্থের সারাংশ। আর সূরা ফাতেহা হচ্ছে আল কুরআনের সারাংশ এবং ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ হচ্ছে সূরা ফাতেহার সারাংশ। প্রকৃতপক্ষে সকল আসমানী কিতাবে যা কিছু বিধৃত রয়েছে তা পবিত্র কুরআন মজীদে রয়েছে, বরং কুরআন মজীদে আরো বিশাল জ্ঞান-ভান্ডার লুকায়িত রয়েছে। আবার কুরআন মজীদ সাত মনযিলের সমাহার। এই সাত মনযিলে যা গচ্ছিত রয়েছে তার সমুদয় জ্ঞান-ভান্ডার কুরআন মজীদের সাতটি আয়াত “সূরাতুল ফাতেহার” ভিতর নিহিত রয়েছে। আর সূরা ফাতেহার সাতটি আয়াতের সমুদয় জ্ঞান بسم الله الرحمن الرحيم  এর মাঝে নিহিত রয়েছে। بسم اللہ الرحمن الر حیم এর ভিতর যা কিছু নিহিত আছে তার সমুদয় সাতটি হরফ بسم اللہ এর ভিতর নিহিত রয়েছে। অনন্তর ঐ সাতটি বর্ণের জ্ঞান তার একটি মাত্র হরফ ب এর ভিতর নিহিত রয়েছে। আবার ঐ একটি হরফ ب এর সমুদয় জ্ঞান তার একটি নুক্বতা বা বিন্দুর মধ্যে লুকায়িত রয়েছে। তাইতো কবি বলেছেনÑ
مندرج ہے ایک نقطہ مین علوم دوجہان
جوش زن دريا ہوا قطرہ سے ديکہو بيگمان
(মোনদারেয হ্যায় এক নোক্তা মে উলুমে দো জাহান
জোশ যান্ দারইয়া হুয়া কাতরে ছে দেখো বে গুমান)
“দু’জাহানের জ্ঞান-ভান্ডার এক নুকতায় বিদ্যমান
এক ফোঁটা বারি হতে মহা সাগর বহমান। ”
বিসমিল্লাহর বা (ب) এর নোকতা নূর, লৌহ মাহফুজের নূরের মেমোরী সেলের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে নূরে মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ডিসপ্লের মাঝে এমনভাবে সংযোগ সাধন হয় যাতে এ নুকতার মাঝে গোটা কুরআন সিরাজুম মুনীর নূর সাগরের কাতরাতে মিলিত হয়ে এমন এক ‘ওসঢ়ড়ংবফ ঢ়ড়বিৎ’ বা সরাসরি মূল শক্তির সাথে সম্পৃক্ত হয় যাতে হরফের কুরআন কোন ওস্তাদ ছাড়া সর্বোচ্চ সুরে তিলাওয়াত করতে সক্ষম হয়। এতে মহান আল্লাহর কুদরত এমনভাবে প্রকাশিত হয় যে, আল্লাহর প্রিয় হাবীবের ইলম আল্লাহ প্রদত্ত জাতি ইলম যার তুলনা তিনি নিজেই- তরীকতের পরিভাষায় যাকে ‘ফয়যে ইত্তেহাদী’ বলে। এ ধরণের বাস্তবতা প্রিয় নবীর শান ও মানের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র। এখন প্রশ্ন জাগে মহান আল্লাহ বিসমিল্লাহর বা (ب) এর নুকতার লাখো ভাগের একভাগ দিয়ে ইলম দান করা তার জন্য খুবই ক্ষুদ্র কাজ। কিন্তু প্রিয় নবীকে ‘النبى الامى’ বা অক্ষরজ্ঞানমুক্ত বলার কারণ, তাৎপর্য কি? এর জবাবে বলা যায়;
উম্মুন অর্থ: বিশ্ববিখ্যাত আরবী ভাষাবীদ খলিল বলেন,
كل شيئ ضم اليه سائر ما يليه أُما-
    “সম্পৃক্ত হওয়ার মত সব কিছু যে বস্তুর সাথে মিলিত হয় তাকেই উম্মুন বলা হয়। ” (কাওয়ায়েদুল ফিকহ-১৮৯ পৃ.)
আর ‘উম্মী’ امة العرب আরব জাতীর সাথে সন্নিবেশিত। আরও বলা হয়েছে,
وهى لم تكن تكتب و تقرأ فاستعير لكل من لايعرف الكتابة و لا القرأة-
‘উম্মী বলতে যারা লিখতে বা পড়তে সক্ষম ছিলনা, পরবর্তীতে যে ব্যক্তিই লিখতে বা পড়তে জানতো না তার জন্যই উম্মী পরিভাষা ব্যবহার হতো।” (কাওয়ায়েদুল ফিকহ-১৯৩ পৃ.)
এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী রহমতুল্লাহে আলাইহি লিখেন,
الامى } الذى ر يكتب ولا يقرأ وكونه عليه السلام اميا من جملة معجزاته فانه عليه السلام لو كان يحسن الخط والقراءة لصار متهما بانه ربما طالع فى كتب الاولين والآخرين فحصل هذه العلوم بتلك المطالعة فلما اتى بهذا القرآن العظيم المشتمل على علوم الاولين من غير تعلم ومطالعة كان ذلك من جملة معجزاته الباهرة – (تفسير حقي - ৪ /২৮৮)
    ‘উম্মী’ বলতে যে লিখতে বা পড়তে পারেন না। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মী থাকাই তাঁর অন্যতম মুজিযা। কেননা তিনি যদি ভালো লিখতেন বা পড়তেন তা হলে এ অপবাদ দেয়ার সুযোগ থাকতো যে, তিনি অতীত ও বর্তমানের বহু গ্রন্থ অধ্যয়ন ও গবেষণা করে এ জ্ঞান অর্জন করেছেন। পবিত্র কুরআন অতীতের জ্ঞান ভান্ডার নিয়ে কোন শিক্ষা গ্রহণ বা গবেষণা ছাড়াই তাঁর কাছে অবতীর্ণ হয়ে এটা এক বিস্ময়কর মুজিযা হিসেবে প্রতিভাত হল। (তাফসীরে হাক্কী-৪/২৮৮)
তবে উম্মী অর্থ যদি কেউ মূর্খ বা অশিক্ষিত করে প্রিয়নবীর সাথে সম্পৃক্ত করে বসেন তাহলে তার ঈমান থাকবে না। কারণ এ তরজমায় প্রিয় নবীর শানে উজমায় আঘাত হবে। আর اهانة الرسول كفر তথা রাসূলের শানে আঘাত দেয়া কুফরী। এটা হবে তাঁর প্রতি অপবাদ। কারণ তিনি নিজেই এরশাদ করেন:
عن ابن عباس قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم أتاني الليلة ربي تبارك وتعالى في أحسن صورة قال أحسبه في المنام فقال يا محمد هل تدري فيم يختصم الملأ الأعلى ؟ قال قلت لا قال فوضع يده بين كتفي حتى وجدت بردها بين ثديي أو قال في نحري فعلمت ما في السموات وما في الأرض- سنن الترمذي - (৫ /৩৬৬)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ ফরমান, “এক রাত্রে ঘুমের মধ্যে আমার প্রতিপালক আমার সাথে খুব সুন্দর আকৃতিতে দিদার দিলেন, এবং বললেন হে মুহাম্মদ ! আপনি কি জানেন ঊর্ধ্ব জগতে কি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে? আমি বললাম না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, অত:পর তিনি তাঁর কুদরতী হাত আমার বক্ষে রাখলেন এমনকি আমি তার শীতলতা অনুভব করলাম বুকের মাঝখানে, অত:পর আমি জেনে নিলাম আসমান ও জমিনের মধ্যে যা আছে (সব)। ” (সুনানে তিরমিযি-৫/৩৬৬)
এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ নিরাকার। প্রিয় নবীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ কিভাবে হয়েছে তা আল্লাহর রাসূলই ভালো জানেন। কারণ আল্লাহ জাল্লা শানুহুর অবস্থান সম্পর্কে ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি যা বলেছেন আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকিদা ও তাই। তিনি বলেন ঃ
الاستواء معلوم والكيفية مجهولة والإيمان به واجب والسؤال عنه بدعة-(الملل والنحل للشهرستانى- ১৯১/
‘তাঁর (আল্লাহর) আরশে সমাসীন হওয়াটা জ্ঞাত বিষয়। তাঁর আকৃতি-প্রকৃতি অজ্ঞাত। এর উপর ঈমান আনা ওয়াজিব। এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা বিদআত। ’ (আল মিলাল ওয়ান নিহাল-শাহ্রাসতানী-১/৯১ পৃ.)
সৃষ্টির মাঝে এমন হাজারো গায়েব বা অদৃশ্য জ্ঞান রয়েছে যেগুলো একমাত্র প্রিয় নবীজি জানেন। অন্য মানুষের কাছে যেগুলো গায়েব তাঁর কাছে সেগুলো হাজের। আল্লাহ গায়েব জানেন; এ জানা তাঁর জাতী বা সত্ত্বাগত জ্ঞান যার সাথে তুলনা শিরক। আর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর গায়েবের ইলম عطائى বা আল্লাহ প্রদত্ত যার সাথে তুলনা করা কুফরী। এ জন্যই খাজা আবদুল্লাহ আনসারী রহমতুল্লাহি আলাইহি হাজার বছর পূর্বে তাঁর জ্ঞান সম্পর্কে লিখেছেন-
العلوم كلها قطرة من بحره - و الحكم كلها غرفة من نهره- و الازمان كلها ساعة من دهره- هو الاول فى الوصلة و الاخر فى النبوة والظاهر بالمعرفة والباطن بالحققيقة-
“সকল জ্ঞান তাঁর জ্ঞান সমুদ্রের এক ফোঁটা। সকল বিজ্ঞান তাঁর বিজ্ঞান নদীর এক কোষ পানি। সকল সময় তাঁর সময়ের ব্যাপ্তিতে এক মুহুর্ত। আল্লাহর সান্নিধ্যে তিনি সবার আগে, নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনে সবার শেষে, তাঁর প্রকাশ মা’রেফতের (আধ্যাত্মিক ইলম) জ্ঞানে, হাকীকতে তিনি সম্পূর্ণ গোপন। ” [তাফসীরে কাশফুল আসরার-৩/৭৬৫]
এখন প্রশ্ন হল প্রিয়নবীকে অক্ষরজ্ঞানমুক্ত রাখার রহস্য কী? এর জবাবে বলা যায়, লিখতে না জানা বা লিখা পান্ডুলিপি না পড়া-ই নবীজীর মোজেযা। তিন কারণে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীবকে উম্মী রেখেছেন।
১। যে যুগে যে শাস্ত্রের রাজকীয় কদর ছিল আল্লাহ তা’য়ালা সে যুগের নবীকে সে শাস্ত্রে অনন্য করেছেন। যেমন হযরত মূসা আলাইহিস সালাম এর যুগে যাদুকরদের রাজকীয় সম্মান ছিল। আল্লাহ তায়ালা লাঠির মোজেযা দিয়ে সকল যাদুকরের উপর প্রাধান্য দিয়েছিলেন। হযরত দাঊদ আলাইহিস সালাম এর যুগে কামার ও লৌহ কর্মকারদের কদর ছিল রাজকীয়। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে লোহা নরম করার মোজেযা দিয়েছেন। তার স্পর্শ লাগলেই লোহা নরম হয়ে যেত। এ লোহা দিয়ে দা-কুড়াল-কোদাল যা ইচ্ছা বানাতে সক্ষম ছিলেন। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের যুগে ডাক্তার-হেকিমদের সম্মান ছিল রাজকীয়। সে যুগে জালিয়ানুস বা গৎ. এধষরহং চিকিৎসা শাস্ত্রে অনন্য ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু সে যুগের ডাক্তারগণ কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসা করতে ছিলেন অপারগ। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে কুষ্ঠ রোগ মুক্তি, জন্মান্ধকে চোখ দান, মৃতকে জীবন দানের মত মুজেযা দান করেন। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে কবিদের কদর ছিল রাজকীয়। জাহেলী যুগের কবিদের কবিতা বাইতুল্লাহ শরীফের মত মর্যাদাবান স্থানে সোনালী অক্ষরে লিখে ঝুলিয়ে রাখা হত। তাদের কবিতার মান এতই উন্নত ছিল যে, অদ্যাবধি কেউ ঐ মানের কবিতা রচনা করতে সক্ষম হয়নি। সেগুলোকে ‘المعلقات’ বা ঝুলন্ত গীতি কবিতা বলা হত। আল্লাহ তায়ালা উম্মী (প্রচলিত অর্থে লিখতে বা পড়তে অভ্যস্ত নন এমন) নবীর মুখ দিয়ে এ উন্নত সাহিত্য, নির্ভুল কুরআন মানব জাতির সামনে উপস্থাপন করলেন। যার সামনে সকল সাহিত্য ও কবিত্ব ম্লান হয়ে যায়। রাসূলে খোদার মুখ নিসৃতঃ কালাম যে আল্লাহরই কালাম তা প্রমাণিত হয়ে যায়। যদি তিনি অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন হতেন তাহলে হয়ত মনে করা হত সাহিত্য চর্চা করে অন্যদের চেয়ে একটু উন্নত কবি বা সাহিত্যিক হয়েছেন। কিন্তু অক্ষরজ্ঞানমুক্ত নবীর মুখে এ কুরআন তাঁর উম্মী হওয়ার ফলেই সবাইকে নাড়া দিয়েছে। অক্ষরজ্ঞানমুক্ত হওয়ার ফলেই তাঁর মর্যাদা সবার সামনে উদ্ভাসিত হয়েছে। সবাই বুঝতে পেরেছে- ليس هذا من كلام البشر অর্থাৎ এটি (কুরআন) কোন মানুষের কালাম নয়।
২। আল্লাহ তায়ালার এ সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হলেন তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আল্লাহর পরই মর্যাদার দিক থেকে তাঁর স্থান। যদি দুনিয়ার কোন মানুষের কাছে তিনি অক্ষরজ্ঞান শিখতেন তাহলে আল্লাহ ও তাঁর হাবীবের মর্যাদার মাঝে ওস্তাদের মর্যাদা স্থান নিত। কিন্তু আল্লাহ চাইলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর মর্যাদা পেতে পারে এমন কোন সৃষ্টি থাকবেনা। তাই তিনি তাঁকে ‘উম্মী’ বা অক্ষরজ্ঞানমুক্ত রাখলেন।
৩। দুনিয়ার যত বড় শিক্ষকই হোক না কেন কিছু না কিছু ভুল থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু সাইয়্যেদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৃষ্টি জগতের যিনি মহান শিক্ষক তাঁর মধ্যে যদি একটি শব্দও ভুল থাকে তাহলে গোটা জাতি ধ্বংস হতে বাধ্য। তিনি নিজেই এরশাদ ফরমান-
إنما بعثت معلما – (سنن ابن ماجه)  “আমি শিক্ষক হিসেবেই প্রেরিত হয়েছি”।
এ জন্য আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবীবকে উম্মী রেখে নিজেই শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি নিজেই এরশাদ করেন-
 "أَدَّبَنِي رَبِّي فَأَحْسَنَ تَأدِيبي"- (مرقاة المفاتيح- ২৮৩/)
“আমার রব আমাকে সর্বোৎকৃষ্ট আদব (শিষ্টাচার) শিক্ষা দেয়ায় আমি সর্বোৎকৃষ্ট আদব শিখেছি।”
স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা হলেন শিক্ষক, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন ছাত্র, সিলেবাসের কিতাব হল আল-কুরআন।
এজন্যই সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ বেশী বেশী দরূদে উম্মী শরীফ পড়তেন। দরূদে উম্মী নি¤œরূপ:-
اللهم صل على سيدنا محمدن النبى الامى و اله وسلم-
“হে আল্লাহ আমাদের সর্দার উম্মী নবীর শান ও মান এত উর্দ্ধে যে আমার পক্ষে তাঁকে সালাত ও সালাম পেশ করা আদৌ সম্ভব নয়। তুমি তাঁর উপর এবং তাঁর বংশধরদের উপর সালাত-সালাম পাঠাও।”
সব সময় অজুর সাথে থেকে এ দরূদ মুহাব্বতে পড়লে অল্প সময়ে প্রিয় নবীজীর জিয়ারত নসীব হয়।
আল্লাহ আমাদেরকে প্রিয়নবীর নূরাণী চেহারা মুবারক দেখার এবং তাঁর কদম মুবারকে চুম্বন করার তাওফীক দিন, আমীন।
কার্যকরী কমিটি গঠন
গত ২৭/০২/২০১৪ ইং তারিখে গাজীপুরী ক্বাদেরীয়া সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় খানকায়ে সোবহানীয়া শাহপুর দরবার শরীফে সংগঠনের কার্যকরী কমিটি গঠনপূর্বক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় উক্ত সংগঠনের প্রধান পৃষ্টপোষক শাহপুর দরবার শরীফের গদ্দিণীশিনপীর ছাহেব আলহাজ্ব অধ্যাপক মুহাম্মদ পিয়ারা আল-ক্বাদেরী প্রত্যক্ষ দিক নির্দেশনায়  গাজীপুরী ক্বাদেরীয়া সংগঠনের কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়। নিম্নে সংগঠিত কমিটির সদস্যদের নামের তালিকা পদবীসহ প্রকাশ করা হলো:

 
সভাপতি
আলহাজ্ব মাও. মুফতী কাজী আবুল বাশার আল-ক্বাদেরী
সহ-সভাপতি
শেখ শাহ্জাদা ইয়াসির আহমদ সোবহান
শেখ শাহ্জাদা আহসান হাবিব সোবহানী (কাওসাইন)
ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল আলম শামিম
মোঃ শাহাদাৎ হোসেন পাটোয়ারী
মহাসচিব
মাও. মুহাম্মদ মামুনুর রশীদ আল-ক্বাদেরী আল আযহারী
সহকারী সচিব
মাও. কাজী মোস্তাফিজুর রহমান বাশারী
অর্থ সচিব
মাও. মুহাম্মদ ওসমান গণি আল-ক্বাদেরী
সাংগঠনিক সম্পাদক
হাফেজ মাও. রুহুল আমিন আল-ক্বাদেরী
প্রচার সম্পাদক
মুহাম্মদ কাসওয়া (জিসান)
সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক
মাও. আলাউদ্দিন আল-ক্বাদেরী
দপ্তর সম্পাদক
মাও. শামছুদ্দোহা বারী আল-ক্বাদেরী
 
بسم الله الرحمن الرحيم
দারসূল হাদীস: মাহে রমাদ্বান ও সিয়ামের ফজিলত
মাওলানা মুফতী কাজী আবুল বাশার আলক্বাদেরী
প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, ফকির বাজার ইসলামিয়া ছুন্নিয়া সিনিয়র মাদরাসা

সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ও জাতীয় ইমাম সমিতি, বুড়িচং, কুমিল্লা।
রমজান মাসের ফজিলত:
আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ الْحَسَنَةُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعمِائَة ضِعْفٍ ، قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ : إِلا الصَّوْمَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ ، يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَطَعَامَهُ مِنْ أَجْلِي ، لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّهِ وَلَخُلُوفُ فِيهِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ-
অর্থাৎ প্রতিটি আদম সন্তানের নেক কাজের ফল দশগুণ হতে সাতশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি হয়ে থাকে। আল্লাহ তাবারুকু ওয় তায়ালা বলেন, তবে রোযাকে এর মধ্যে গণ্য করা হবে না। কারণ, রোযা কেবল আমারই জন্য। আর আমিই এর প্রতিদান দেব। আমার জন্য সে আহার ও যৌনচাহিদা পরিহার করে। রোযাদারের আনন্দ দু’টি : একটি আনন্দ তার ইফতারের সময়। আরেকটি আনন্দ আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের আনন্দ। রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের সুগন্ধির চাইতেও সুগন্ধিময়। [মুসলিম : ১১৫১; তিরমিযী : ৬৫৯; নাসায়ী : ২১৮৫]
হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
قَالَ اللَّهُ : كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلاَّ الصِّيَامَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ ، وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ ، وَلاَ يَصْخَبْ فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ ، أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ يَفْرَحُهُمَا إِذَا أَفْطَرَ فَرِحَ ، وَإِذَا لَقِيَ رَبَّهُ فَرِحَ بِصَوْمِهِ-
অর্থাৎ আল্লাহ বলেছেন, রোযা ছাড়া আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য; শুধু রোযা ছাড়া। কারণ, তা আমার জন্য, তাই আমিই এর প্রতিদান দেব। রোযা ঢাল স্বরূপ। রোযা রাখার দিন তোমাদের কেউ যেন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া বিবাদ না করে, যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে ঝগড়া করে তাহলে সে যেন বলে আমি রোযাদার। যাঁর হাতে মুহাম্মদের জীবন তাঁর শপথ! অবশ্যই (অনাহারের দরুণ সৃষ্ট) রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধির চেয়েও সুগন্ধিময়। রোযাদারের জন্য রয়েছে দু’টি আনন্দের সময় : একটি হলো ইফতারের সময় আর অপরটি (কিয়ামতের দিন) তার প্রভুর সাথে সাক্ষাতের সময়। [বুখারী : ১৯০৪; মুসলিম : ২৭৬২]
এ মাসের অন্যতম বরকত হল ভাল কাজের প্রতিদান অনেক বেড়ে যায়। যেমন- রাত্রে দাড়িয়ে নামাজ আদায় করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের রাত্রে দাড়িয়ে নামাজ পড়তে উৎসাহ দিয়েছেন। রমজান তো গুনাহ মাফ ও মিটিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে আরো বেশি সুযোগ দিয়েছে। হাদিসে এসেছে -
من صام رمضان إيمانا واحتسابا غفر لـه ما تقدم من ذنبه-(رواه الشيخان)
অর্থাৎ যে রমজান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে সিয়াম পালন করবে তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (বোখারি ও মুসলিম)
হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হল আল্লাহর পক্ষ থেকে যে ক্ষমার ওয়াদা করা হয়েছে তা তিনটি শর্ত সাপেক্ষে-
প্রথম : রমজানের সিয়াম পালন করতে হবে ঈমানের সাথে। অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান এবং সিয়াম যে একটি ফরজ ইবাদত এর প্রতি বিশ্বাস। সিয়াম পালনকারীকে আল্লাহ যে সকল পুরস্কার দেবেন তার প্রতি বিশ্বাস রাখা।
দ্বিতীয় : সিয়াম পালন করতে হবে ইহতিসাবের সাথে। ইহতিসাব অর্থ হল আল্লাহর পক্ষ থেকে সওয়াব ও পুরস্কারের আশা করা, তাকে সন্তুষ্ট করতেই সিয়াম পালন করা আর সিয়ামকে বোঝা মনে না করা।
তৃতীয় : কবিরা গুনাহ থেকে দূরে থাকতে হবে। কবিরা গুনাহ ঐ সকল পাপকে বলা হয় যেগুলোর ব্যাপারে ইহকালীন শাস্তির বিধান দেয়া হয়েছে, পরকালে শাস্তির ঘোষণা রয়েছে, অথবা আল্লাহর ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে লানত (অভিসম্পাত) বা ক্রোধের ঘোষণা রয়েছে। যেমন, শিরক করা, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ আত্মসাত করা, ব্যভিচার করা, জাদু-টোনা, অন্যায় হত্যা, মাতা-পিতার সাথে দুর্ব্যবহার, আত্মীয়তার সম্পর্কচ্ছেদ, মিথ্যা সাক্ষ্য, মিথ্যা মামলা, মাদক সেবন, ধোঁকাবাজি, মিথ্যা শপথ, অপবাদ দেয়া, গিবত বা পরদোষচর্চা, চোগলখোরি, সত্য গোপন করা ইত্যাদি।
এ মাসে মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إِنَّ للهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى عُتَقَاء فِيْ كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ وَإِنَّهُ لِكُلِّ مُسْلِمٍ فِيْ كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ دَعْوَة مُسْتَجَابَة-
অর্থাৎ মাহে রমাযানে প্রতিরাত ও দিনের বেলায় বহু মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নাম থেকে মুক্তির ঘোষণা দিয়ে থাকেন এবং প্রতিটি রাত ও দিনের বেলায় প্রত্যেক মুসলিমের দু‘আ ও মুনাজাত কবূল করা হয়ে থাকে। [মুসনাদ আহমদ : ৭৪৫০]
রমযানের শেষ দশকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে ইবাদতে মনোনিবেশ করতেন।
আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَجْتَهِدُ فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مَا لا يَجْتَهِدُ فِي غَيْرِه-
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে বেশি বেশি ইবাদতে মনোনিবেশ করতেন, যতটা তিনি অন্য দিনগুলোতে করতেন না। [মুসলিম : ১১৭৫; তিরমিযী : ৭২৬]
আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন-
إِنَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ وَأَحْيَا لَيْلَهُ وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ-
অর্থাৎ রমযানের শেষ দশক এলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর লুঙ্গি শক্ত করে বাঁধতেন এবং তিনি এর রাতগুলোতে নিজে জাগতেন আর পরিবারকেও জাগাতেন। [বুখারী : ২০২৪; মুসলিম : ১১৭৪; নাসায়ী : ১৬২১]
এ মাসের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করার অনেক গুরুত্ব রয়েছে। ই‘তিকাফে বসলে ইবাদতের মওসুম রমযানকে যথার্থভাবে কাজে লাগানো সহজতর হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করতেন। আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ-
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করতেন। [বুখারী : ২০২৫; মুসলিম : ১১৭১; আবূ দাউদ : ২১০৯] আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকেও অনুরূপ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। [মুসলিম : ১১৭২]
এ মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দানের কথা বলতে গিয়ে সাহাবায়ে কেরাম বলেন:   
كان النبي  صلى الله عليه وسلم  أجود الناس بالخير، وكان أجود ما يكون في رمضان حين يلقاه جبريل- [رواه البخاري ومسلم]
অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম সমস্ত মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন। রমজানে যখন তিনি জিবরীলের সাথে সাক্ষাৎ করতেন আরো বেশি দানশীল হয়ে যেতেন। (বুখারী, মুসলিম)
দান সদকা করা ভাল। বিশেষ করে রমজান মাসে বেশি করে করা। রমজান মাসে অধিক পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত করা, সালফে সালেহীনগণ রমজান মাসে নামাজে এবং নামাজ ব্যতীত অধিক পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত করতেন।
সিয়াম বা রোযার ফজিলত:
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হাদিসে কুদসিতে বলেন-
كل عمل ابن آدم لـه إلا الصيام، فإنه لي وأنا أجزى به- ( رواه مسلم)
অর্থাৎ মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য, কিন্তু সিয়াম শুধু আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান দেব। (মুসলিম)
এ হাদিস দ্বারা আমরা অনুধাবন করতে পারি নেক আমলের মাঝে সিয়াম পালনের গুরুত্ব আল্লাহর কাছে কত বেশি। তাই সাহাবি হযরত আবু হুরায়রা (রা.) যখন আল্লাহর হাবীবকে বলেছিলেন -
يا رسول الله مرني بعمل، قال عليك بالصوم فإنه لا عدل لـه- ( رواه النسائي)
অর্থাৎ হে রাসূলুল্লাহ! আমাকে অতি উত্তম কোন নেক আমলের নির্দেশ দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি সিয়াম পালন করবে। মনে রেখ এর সমমর্যাদার কোন আমল নেই। (নাসায়ি)
সিয়ামের এত মর্যাদার কারণ কী তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ভাল জানেন। তবে, আমরা যা দেখি তা হল, সিয়াম এমন একটি আমল যাতে লোক দেখানো ভাব থাকে না। বান্দা ও আল্লাহ তাআলার মধ্যকার একটি অতি গোপন বিষয়। সালাত, হজ, জাকাতসহ অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি কে করল তা দেখা যায়। পরিত্যাগ করলেও বুঝা যায়। কিন্তু সিয়াম পালনে লোক দেখানো বা শোনানোর ভাবনা থাকে না। ফলে সিয়ামের মধ্যে এখলাস বা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা নির্ভেজাল ও বেশি থাকে। অন্য একটি রেওয়ায়েতে এসেছে-
عن أبي هريرة رضي الله عنه أنه قال يا رسول الله مرني بأمر ينفعني الله به، قال: عليك بالصوم فإنه لا مثل له- (رواه النسائي)
অর্থাৎ হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত যে তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে এমন একটি কাজের নির্দেশ দিন যার দ্বারা আমি লাভবান হতে পারি। তিনি বললেন তুমি সিয়াম পালন করবে। কেননা, এর সমকক্ষ কোন কাজ নেই। (নাসায়ি)
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের জন্য সিয়ামের সাথে কোন আমলের তুলনা হয় না। সিয়াম পালনকারীদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহের আরেকটি দৃষ্টান্ত হল তিনি সিয়াম পালনকারীদের জন্য জান্নাতে একটি দরজা নির্দিষ্ট করে দেন। যে দরজা দিয়ে সিয়াম পালনকারীরা ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
إن في الجنة بابا يقال له الريان، يدخل منه الصائمون يوم القيامة لا يدخل منه أحد غيرهم، يقال أين الصائمون ؟ فيقومون لا يدخل منه أحد غيرهم، فإذا دخلوا أغلق، فلم يدخل منه أحد- ( متفق عليه)
অর্থাৎ জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে। যার নাম রাইয়ান, কেয়ামতের দিন সিয়াম পালনকারীরাই শুধু সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। তাদের ছাড়া অন্য কেউ সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। সেদিন ঘোষণা করা হবে, সিয়াম পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়িয়ে যাবে সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করার জন্য। যখন তারা প্রবেশ করবে দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে ফলে তারা ব্যতীত অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারি ও মুসলিম)
হাদিস শরীফে এসেছে -
للصائم فرحتان فرحة عند فطره، وفرحة عند لقاء ربه- (متفق عليه)
অর্থাৎ সিয়াম পালনকারীর জন্য দুটি আনন্দ : একটি হল ইফতারের সময় অন্যটি তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের সময়। (বুখারি ও মুসলিম)
ইফতারের সময় আনন্দ হল এ কারণে যে, সিয়াম পূর্ণ করতে পারল ও খাবার-দাবারের অনুমতি পাওয়া গেল। এটা বাস্তব সম্মত আনন্দের বিষয় যা আমাদের সকলের বুঝে আসে ও অনুভব করি। অপরদিকে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের যে আনন্দ তা অনুভব করতে আমরা এখন না পারলেও কেয়ামতের দিন পারা যাবে।
সিয়ামের ক্ষমতা সম্পর্কে হাদীস শরীফে এসেছে-
عن عبد الله بن عمرو أن النبي صلى الله عليه وسلم قال الصيام والقرآن يشفعان للعبد يوم القيامة، يقول الصيام أي رب منعته الطعام والشهوات بالنهار، فشفعني فيه ويقول القرآن  منعته النوم بالليل، فشفعني فيه - 
অর্থাৎ আব্দুল্লাহ বিন আমর থেকে বর্ণিত যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন সিয়াম ও কোরআন কেয়ামতের দিন মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, সিয়াম বলবে হে প্রতিপালক! আমি দিনের বেলা তাকে পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। কোরআন বলবে হে প্রতিপালক! আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। তিনি বলেন, অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে। (আহমদ)
কোন ধরনের সিয়াম এ সকল ফজিলত অর্জন করতে পারে:
যে সকল ফজিলত ও সওয়াবের কথা এতক্ষণ আলোচনা করা হল তা শুধু ঐ ব্যক্তি লাভ করবে যে নিম্নোক্ত শর্তাবলি পালন করে সিয়াম আদায় করবে।
(১) সিয়াম একমাত্র আল্লাহর জন্য আদায় করতে হবে। মানুষকে দেখানো বা শোনানো অথবা মানুষের প্রশংসা অর্জন কিংবা স্বাস্থ্যের উন্নতির নিয়তে সিয়াম আদায় করবে না।
(২) সিয়াম আদায়ের ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলের সুন্নত অনুসরণ করতে হবে। সেহরি, ইফতার, তারাবীহসহ সকল বিষয় রাসূলের সুন্নত অনুযায়ী আদায় করতে হবে।
(৩) শুধু খাওয়া-দাওয়া ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকলে যথেষ্ট হবে না। মিথ্যা, পরনিন্দা, অশ্লীলতা, ধোঁকাবাজি, ঝগড়া-বিবাদসহ সকল প্রকার অবৈধ কাজ হতে বিরত থাকতে হবে। মুখ যেমন খাবার থেকে বিরত থাকে, তেমনিভাবে চোখ বিরত থাকবে অন্যায় দৃষ্টি থেকে, কান বিরত থাকবে অনর্থক কথা ও গান-বাজনা শোনা থেকে, বা বিরত থাকব অন্যায়-অসৎ পথে চলা থেকে।
সিয়াম পালনে মহান উদ্দেশ্য এটাই যে, সিয়াম পালনকারী শরিয়তের দৃষ্টিতে সকল প্রকার অন্যায় ও গর্হিত আচার-আচরণ থেকে নিজেকে হেফাজত করবে। অতএব সিয়াম হল সকল ভাল বিষয় অর্জন ও অন্যায়-গর্হিত কাজ ও কথা বর্জন অনুশীলনের একটি শিক্ষালয়।
তাইতো রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
من لم يدع قول الزور والعمل به والجهل فليس لله حاجة أن يدع طعامه وشرابه- ( رواه البخاري)
অর্থাৎ যে মিথ্যা কথা ও কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করতে পারল না তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (বুখারি)
মুসনাদে আহমদে এসেছে-
رب صائم حظه من صيامه الجوع والعطش، ورب قائم حظه من قيامه السهر- ( رواه أحمد)
অর্থাৎ অনেক সিয়াম পালনকারী আছে যারা তাদের সিয়াম থেকে শুধু ক্ষুধা ও পিপাসা অর্জন করে। আবার অনেক সালাত আদায়কারী আছে যারা তাদের সালাত থেকে শুধু রাত-জাগা লাভ করে থাকে। (এ ছাড়া আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন প্রতিদান লাভ করে না) (আহমদ)
সুতরাং পবিত্র এ মাসটি ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাটানো অর্থাৎ সাওম পালন করা এবং কোনো ইবাদতগাহে একাকী নির্জনে থাকা তথা ই‘তিকাফ করা এবং ওহী নাযিলের রাত তথা লাইলাতুল কদরে নির্ঘুম থেকে ইবাদত-বন্দেগী করা ও সিজদানবত থাকা সকল মুসলমানের কর্তব্য। যাতে আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত নিয়ামত থেকে আমরা পূর্ণরূপে লাভবান হতে পারি এবং নিয়ামতের কথা স্মরণ করে মহান রবের শুকরিয়া আদায় করি।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে পূর্ণ সাফল্য ও কামিয়াবীর সঙ্গে মাহে রমযান যাপনের তাওফীক দান করুন। আমাদের সকলকে মাহে রমযানে ক্ষমা ও জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় জায়গা দিন। আমীন। ইয়া রব্বাল আলামীন।

আহকামে রমাদ্বান বা রোযার বিধানাবলী
মাও. গোলাম মোস্তাফা মুহাম্মাদ শামছুদ্দোহাবারী
কাঠাঁলিয়া দরবার শরীফ, লাকসাম

ইসলামের ৫টি স্তম্ভের মধ্যে রমযানের রোযা হচ্ছে অন্যতম। এ রোযা প্রত্যেক আকেল, বালেগ, মুসলমানের উপর অবশ্যই ফরজ। যে ব্যক্তি রমযানের রোযা রাখাকে ফরজ মনে না করে সে ব্যক্তি কাফির হয়ে যাবে। আর যে ফরজ জেনেও না রাখে, সে কবীরা গুনাহগার যার তাওবা এবং কাফ্ফারা একত্রে ওয়াজিব। আল্লাহ তায়া’লার ইচ্ছায় নিম্মে রোযা রাখার কিছু হুকুম-আহকাম বর্ণনা করছি-
রোযা:
মুুসলিম, আকেল, বালেগ নর-নারীগণ সূবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ইবাদতের নিয়্যাতে পানাহার এবং যৌন সংগম হতে বিরত থাকাই রোযা। নারীদের এ সময় হায়েয- নেফাস হতে পবিত্র থাকা পূর্বশর্ত (ফাত্য়ায়ে আলমগীরী)
*    রমযানের এক মাস রোযা রাখা অবশ্যই ফরজ। হাদীস শরীফে বর্ণীত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান- মাস উনত্রিশ দিনের হয়, ত্রিশ দিনেও হয় বিধায় চাঁদ দেখে রোযা রাখো এবং চাঁদ দেখেই রোযা ভঙ্গ কর। আর যদি উনত্রিশ রমযানে চাঁদ দেখা না যায় তাহলে ত্রিশদিন পূর্ণ করো (খাযাইনুল ইরফান)
রোযার নিয়্যাত:
রোযার জন্য নিয়্যাত করাও অত্যাবশ্যক। প্রত্যেক রোযার জন্য অন্তরে ইচ্ছা থাকার মাধ্যমে নিয়্যাতের শর্ত পূরন হবে। মুখে উচ্চারণ করা মুস্তাহাব। এ নিয়্যাত পূর্বদিনের সূর্যাস্তের পর হতে রোযার দিনের দুপুরের আগ পর্যন্ত করা যাবে। এর আগের বা পরে করলে রোযা হবেনা।
*    রোযার নিয়্যাতে সেহরী খাওয়া ও নিয়্যাত হিসাবে গণ্য হবে। সুবহে সাদিকের পূর্বে নিয়্যাত করলে বলবেন- নাওয়াইতু আন অসূম্মা গাদাম মিন শাহরে রামাদ্বানাল মুবারাকি ফারদ্বাল লাকা ইয়া আল্লাহু ফাতাক্বাব্বাল মিন্নি ইন্নাকা আনতাস সামীউল আলীম।
অর্থ: আমি আল্লাহর জন্য আগামী কাল রমাযানের রোযার নিয়্যাত করলাম।
*    আর ফজরের পর নিয়্যাত করলে বলবেন- নাওয়াইতু আন আসূম্মা হাযাল ইওয়ামা লিল্লাহি তায়া’লা মিন ফারদ্বি রামাদ্বানা অর্থাৎ আল্লাহর জন্য আমি আজকের রমযানের ফরজ রোযা রাখার নিয়্যাত করলাম।
*    রোযার নিয়্যাত রাতে বা ফজরের আগে করাই মুস্তাহব। রোযার নিয়্যাত কার্যকর হয় সুবহে সাদিক হতে। অতএব কারো দিনের (মধ্যাহে“র পূর্ব পর্যন্ত) নিয়্যাত ঐ সময় শুদ্ধ হতে পারে যদি নিয়্যাতকারী সুবহে সাদিক হতে রোযা ভঙ্গের কোন কাজ না করে (রদ্দুল মুহতার)
*    সাহরী খাওয়া রোযার নিয়্যাত রূপে গণ্য হয় কিন্ত সে সময় যদি ইচ্ছা থাকে যে, সকালে রোযা রাখবে না তাহলে সাহরী খাওয়া নিয়্যাত বলে গণ্য হবে না (দুররে মুখতার)
*    ঐদিন কোন নারী হায়েয বা নেফাস অবস্থায় রাতে রোযার নিয়্যাত করে থাকে এবং সুবহি সাদিকের পূর্বেই পবিত্র হয়ে যায়, তবে তার রোযা রোযা শুদ্ধ হবে (জাওয়াহের)
*    ঘুমন্ত অবস্থায় রোযাদার তার সহধর্মীনির সাথে সহবাস করলে উভয়ের রোযা নষ্ট হবে ক্বাযা ও কাফ্ফার ওয়াজিব হবে কেবল স্বামীর উপর। আর নারীর জন্য শুধু ক্বাযা আদায় করবে।
রোযার কাফ্ফারা:
বিরতিহিন ভাবে ৬০টি রোযা রাখা। শারীরিক ভাবে সামর্থবান না হলে ৬০ জন মিসকীন বা অভাবীকে দুইবেলা পেট ভরে আহার করানো, তা নাহলে সমপরিমান অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
রমযানের রোযা যাদের জন্য পরে রাখার অবকাশ রয়েছে:
*    সফর, গর্ভধারণ, সন্তানকে দুধ পানকালীন, রুগ্ন অবস্তায়, বার্ধক্য, শারীরিক ও মানসিক কোন প্রকার ক্ষয়- ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে এসব কারনে রোযা না রেখে ক্বাযা করলে গুনাহগার হবেনা। (আলমগীরী)
*    বিনা ওজরে এ মাসে রোযা না রাখা কবীরা গুনাহ। পীড়িত লোক নিজ অনুমান ভিত্তিক রোযা ছেড়ে দিতে পারবে না। যতক্ষন পর্যন্ত সে ব্যক্তি কোন দ্বীনদার ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ব্যবস্থাপত্র নিবে। নতুবা ক্বাযা কাফ্ফারা ওয়াজিব হবে। (খাযাইনুল ইরফান) গর্ভবতী বা সন্তানদাত্রী রমণী যদি রোযার কারনে স্বীয় সন্তানের জীবনহানী অথবা এমন অসুস্থাতা যাতে রোযা রাখা সম্ভব নয়। এমন ব্যক্তির জন্য পরবর্তীতে রোযা রাখার অবকাশ রয়েছে। (দুররে মুখতার)
*    বার্ধক্য জনিত দুর্বলতা হেতু রোযা রাখতে অসামর্থ হলে তার জন্য ক্বাযা করার অনুমতি রয়েছে। আর যদি সে ব্যক্তির দূর্বলতা ও রোগ ভাল না হওয়ার সম্ভবনা না থাকে এক্ষেত্রে তিনি প্রত্যেক রোযার পরিবর্তে একজন মিসকীনকে দু’বেলা ভাত পেট ভরে খাওয়াবে। অথবা অর্ধ সা’ (২ কেজি ৫০ গ্রাম) গম বা গমের আটা কিংবা দ্বি-গুন যবের সমমূল্য ফিদিয়া হিসাবে প্রদান করবে।
*    যদি ফিদিয়া প্রদানের পর পূনরায় রোযা রাখার মত সামর্থ ফিরে আসে তবে তাকে তখন রোযার ক্বাযাও আদায় করতে হবে।
*    হায়েয ও নেফাস অবস্থায় রমণীদের জন্য রোযা রাখা নিষেধ। তা পরে ক্বাযা করবে।
*    কোন নারীর হায়েয ও নিফাস জনিত রক্তশ্রাব শুরু হওয়া মাত্র তার রোযা ভঙ্গ হয়ে যায় অতএব এ থেকে পবিত্র হওয়ার পর রোযা পালন করবে।
*    কোন রমণীর যদি রাতেই হায়েয বন্ধ হয় তবে সুবহি সাদিক থেকে রোযা রাখবে।
*    কোন রমণীর দশদিনের ভিতরে হায়েয বন্ধ হলে তার জন্য গোসলের সময় ও হায়েযের মধ্যে অর্ন্তভুক্ত। তা এ রাতের এমন সময় যদি সে পবিত্র হয় যে গোসল সমাপন করতে ফজর হয়ে যায় তবে তার জন্য সেদিন রোযা রাখা শুদ্ধ হবে না।
*    ক্ষুধা ও পিপাসা যদি এতই তীব্র প্রকট হয় যে রোযা ভঙ্গ না করলে মৃত্যু বা কোন প্রকার ক্ষতির সম্ভবনা হবে এমতাবস্থায় চাইলে রোযা ভঙ্গ করতে পারবে। তবে পরে তাকে ক্বাযা আদায় করতে হবে।
*    রোযা না রাখার অবকাশ প্রাপ্তরা রোযা পরবর্তী সময়ে ক্বাযা আদায় করবে সময় সীমা পরবর্তী রমযানের পূর্ব পর্যন্ত। এ সমস্ত রোযা রাখার তাকিদ দিয়ে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে যে- পূর্ববর্তী রমযানের রোযা আদায় না করলে তার রোযা কবুল অযোগ্য হয়ে যায়। (দুররে মুখতার)
*    যদি অবকাশ প্রাপ্তগণ তাদের অবকাশকালীন সময়ে ক্বাযা আদায় না করে মৃত্যুবরণ করে তবে রোযার বিনিময়ে ফিদিয়া দেয়া ওয়াজিব নয়। এতদসত্বে অসিয়ত করে গেলে তার সম্পদের এক তৃতীয়াংশ হতে এ অসিয়ত পূর্ণ করা হবে। আর যদি অবকাশের পর ক্বাযা আদায় করতে পারতো তাহলে মৃত্যুকালীন ফিদ্য়িা আদায় করলে শুদ্ধ হবে। যদিও অসিয়ত না করে যায়।
যে সব কারনে রোযা ভঙ্গ হয়না:
*    ভুলবশত: পানাাহার বা যৌন সম্ভোগ সংগঠিত হলে, কিন্তু রোযার কথা স্মরণ হওয়া মাত্রই সে গুলো থেকে বিরত হতে হবে। যদি স্মরণ হওয়া মাত্রই বিরত না হয়ে সে কাজে রত থাকে তবে রোযা নষ্ঠ হয়ে যাবে। (রদ্দুল মুহতার)
*    কোন রোযাদারকে ভুলবশত: পানাহার করতে দেখলে স্মরণ করিয়ে দেয়া ওয়াজিব। কিন্তু যখন রোযাদার অতিশয় দূর্বল হয় এবং স্মরণ করানোর ফলে সে ব্যক্তি পানাহার বন্ধ করবে এবং রোযা রাখা ও তার জন্য অসাধ্য হবে তবে স্মরণ করানো হতে বিরত থাকাই উত্তম। (রদ্দুল মুহতার)
*    মাছি বা এ জাতীয় কিছু ধোয়া, ধুলো-বালি গলায় চলে গেলে রোযা নষ্ঠ হবেনা। কিন্তু ঢোকার পর ইচ্ছাকৃত গিলে ফেললে রোযা নষ্ট হবে।
*    রোযা অবস্থায় স্বপদোষ হলে কিংবা স্বপ্নে কোন কিছু পানাহার করলে রোযার কোন ক্ষতি হবেনা।
*    রোযা অবস্থায় রমণীকে চুম্বন করলে, এতে স্বামীর বীর্যপাত না হলে রোযা ভঙ্গ হবেনা। এমনিভাবে লজ্জাস্থানের দিকে বারবার তাকালেও রোযা নষ্ঠ হবেনা, যদি স্পর্শ না করে। (জাওহারাত, দুররে মুখতার)
*    জিহ্বা দ্বারা লবণের মাত্রা দেখে থুথু ফেলে দিলে এবং মুখ পরিস্কার করে ফেললে রোযার ক্ষতি হবেনা, তবে এতে যদি স্বাদ নিয়ে নেয় তবে রোযা নষ্ট হবে।
যে সব কারনে রোযা ভঙ্গ হবে এবং কাযা আদায় করতে হবে:
*    সুবহি সাদিক্ব হয়নি ভেবে পানাহার বা রমনীকে সম্ভোগ করছে এবং পরে জানতে পারলো তখন সুবহি সাদিক্ব ছিল এ অবস্থায় রোযা রাখবে, তবে ঐ রোযার ক্বাযা আদায় করতে হবে।    
*    সূর্যাস্ত হয়েছে মনে করে সমযের পূর্বে ইফতার করে ফেললে।
*    সুবহে সাদিক্বের পূর্বে পানাহার বা সহবাসরত কিন্তু সুবহি সাদিক্ব হওয়ার পরও খাদ্য, পানীয় বা সহবাস থেকে বিরত থাকেনি এমতাবস্থায় রোযা ক্বাযা করতে হবে।
*    ভুলবশত: সহবাস বা পানাহার করল এবং এতে রোযা নষ্ট হয়েছে মনে করে স্বেচ্ছায় পানাহার করল এতেও ক্বাযা আদায় করতে হবে।
*    নাকে নম্যি টানলে, কানে বা নাকে তেল বা ঔষধ দেয়ায় ভিতরে প্রবেশ করলে, মলদারে বা যৌনাঙ্গে দিয়ে পানি, ঔষধ বা তেল প্রবেশ করালে রোযা ভঙ্গ হবে।
*    রোযাদারের দাঁত উপড়ানোর পর রক্ত কণ্ঠনালীর নিচে পৌছলে রোযা ক্বাযা আদায় করতে হবে
*    ইচ্ছাকৃত মূখভর্তি বমি করলে, অনূরূপ অনিচ্ছা সত্বেও বমি হওয়ায় সামান্য পরিমান গিলে ফেললে রোযা নষ্ট হয়।
*    কুলি বা গোসলের সময় রোযার কথা স্মরণ থাকা সত্বেও কোনভাবে পানি নাক-কান দিয়ে কণ্ঠনালী কিংবা মগজে প্রবেশ করে তবে রোযা ক্বাযা আদায় করতে হবে।
*    সাহরীর পর পান মুখে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে এবং এ অবস্থায় ফজর হয়ে গেলে রোযা ক্বাযা করতে হবে।
রোযা ক্বাযা ও কাফ্ফারা উভয়ই ওয়াজিব হওয়ার কারণসমূহ:
*    ইচ্ছাকৃত ভাবে রোযা অবস্থায় পানাহার বা যৌনমিলন সংঘঠিত করলে।
*    এমনিভাবে রোযা অবস্থায় নেশা জাতীয় দ্রব্য যথা: বিড়ি, সিগারেট, গাজা, মদ ব্যবহার করলে।

তারাবীহ নামায ৮ রাকাত নয়, ২০ রাকাত পড়াই সুন্নাতে মুয়াক্কাদা
মাও মুহাম্মদ আলাউদ্দিন আল ক্বাদেরী
খতীব, এলাহী জামে মসজিদ, চাঁদপুর।

তারাবীহ নামায ৮ রাকাত নয়, বরং ২০ রাকা’ত পড়াই সুন্নাতে মুআক্কাদা। হজরত উমার ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফাত আমলে এ ব্যাপারে সকল সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগণের ইজমা তথা ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। বর্তমানে কেহ যদি আপত্তি এনে ৮ রাকা’ত পড়ে ২০ রাকা’তকে ইন্কার করে তবে কাফির হবে যেহেতু সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগণের ইজমার বিরোধী। নিম্নে ২০ রাকা’ত তারাবীহ নামাযের দলীল পেশ করছি-
তারাবীহর নামায ২০ রাকাত পড়ার দলীল:
১. ‘মুআত্তা’ ইমাম মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র মধ্যে বর্ণিত-
عن سائب بن يزيد قال كنا نقوم في عهد عمر بعشرين ركعة-
অর্থ: হজরত সায়েব বিন ইয়াযিদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমরা হজরত উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফাত আমল থেকে তারাবীহ নামায ২০ রাকা’ত আদায় করতাম।
عن ابن عباس ان النبي صاي الله عليه و اله وسلم كان يصلي في رمضان عشرين ركعة سوي البتر-
অর্থ: হজরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেন, রমযান মাসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বিতর ছাড়াই ২০ রাকা’ত তারাবীহ নামায পড়তেন। (ইবনে আবী শাইবা, তিরমিযী, কাবীর, বাইহাক্বী, আবদ ইবনে হামিদ এবং বাগাবী)
عن الحسنات ان علي بن ابي طالب امر رجلا يصلي بالناس خمس ترويحات عشرين ركعة-
অর্থ: হজরত হাসানাত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নিশ্চয় আলী বিন আবু তালিব রায়িাল্লাহু আনহু পাঁচ বিশ্রামে ২০ রকা’ত তারাবীর নামায আদায়ের নির্দেশ দিতেন।
و عن شبرمة ابن شكل وكان من اصحاب علي انه كنا يؤمهم في رمضان
فيصلي خمس ترويحات عشرين ركعة(رواه البيهقي)
অর্থ: শিবরিমা ইবনে শাকল থেকে বর্ণিত, তিনি হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গী ছিলেন। তিনি রমযান মাসে পাঁচ বিশ্রামে ২০ রাকা’ত তারাবীর নামাযের ইমামতি করতেন। (বায়হাক্বী)
সহীহ তিরমিযী শরীফে باب ما جاءفي قيام شهر رمضان ”নামক অধ্যায়ে আছে-
واكثر اهل العلم علي ما روي عن علي وعمر وغيرهما من اصحب النبي صلي الله عليه واله وسلم عشرين ركعة وهوقول سفيان الثوري وابن المبارك والشافعي وقال الشافعي هكذا أدركت ببلد مكة يصلون عشرين ركعة -
আহলে ইলমগণের আমল ঐ হাদীসে পাকের উপর যা হজরত আলী, উমারসহ অন্যান্য সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগণ হতে (২০ রাকা’ত তারাবীহ সম্বলিত হাদীস) বর্ণিত আছে আর ইহাই ইমাম সুফিয়ান সাওরী, ইবনে মুবারক ও ইমাম শাফেয়ী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগণের অভিমত।
হাদীস পাক বর্ণনাকারী ইমাম তিরমিযী ও ইমাম শাফেয়ী বলেন: আমি নিজে মক্কাবাসীদেরকে দেখেছি যে, তাঁরা (রমযান মাসে) ২০ রাকা’ত তারাবীহ নামায অদায় করত।
সহীহ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ হানাফী মাজহাবের প্রামান্য কিতাব ‘উমদাতুল ক্বারী ফি শারহিল বুখারী ৫ম খন্ড, ৩০৭ পৃষ্ঠায় আছে-
روي الحارث ابن عبيد الرحمن ابن ابي ذباب عن السائب ابن يزيد قال كان القيام علي عهد عمر بثلاث وعشرين ركعة قال ابن عبد الله هذا محمول علي ان الثلاث للوتر -
হজরত ইবনে উবাইদুর রহমান ইবনে আবু যুবাব হজরত সায়েব ইবনে ইয়াযিদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণনা করেন- হজরত উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর যুগে মুসলমানরা ২৩ রাকা’ত নামায আদায় করতেন। হজরত ইবনে আব্দুল্লাহ বলেন- শেষ ৩ রাকা’ত ছিল বিত্র নামায।
পরিশেষে আমরা বলব তারা কাকে মানছে? কোন দলীলের ভিত্তিতে ৮ রাকাত নামায পড়ার কথা বলছে, তারা যদি এ কথা বলতে চায় যে, নবীপাকের আমলে ৮ রাকা’ত ছিলো। তাদের জবাবে বলব ২০ রাকাত নামাজের ভিতর ৮ আছে কিনা? তা হল আর ২০ রাকা’ত সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগণের ইজমা বা ঐক্যমত। আর ২০ রাকা’ত সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগণের ইজমা বা ঐক্যমত যা বাদ দিলে বা ইন্কার করলে কিভাবে তাদের ঈমান থাকতে পারে? মূলত এরা ইয়াহুদীদের ডলার ভোগী দালাল ছাড়া বৈকি?

বদর যুদ্ধ : বিশ্ব মুসলিমের প্রেরণার দীপ্তমশাল
আবুল হাসান মুহাম্মদ বায়েজীদ

অনার্স ২য় বর্ষ,আল হাদিস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদরাসা, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর।
সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ দ্বীন তথা ইসলামের ইতিহাসে যে কয়টি বিপ্লবী ও সোনালী অধ্যায় রয়েছে তন্মধ্যে দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান সংঘটিত ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ অন্যতম। সিহাহ সিত্তাসহ প্রায় সকল হাদিস ও সিরাত গ্রন্থে যেটিকে ‘গাযওয়ায়ে বদর’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। আরবিতে ‘বদর’ মানে হল পূর্ণচন্দ্র বা পূর্ণিমার চাঁদ। রাতের অন্ধকার আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ যেরূপ জ্বলজ্বল করে এবং স্নীগ্ধ জ্যোতি ছড়ায় প্রায় ১৪শত বছর আগে সংঘটিত হক্ব ও বাতিলের মধ্যেকার এ ঐতিহাসিক অনন্য যুদ্ধ ইতিহাসের আয়নায় এবং মুমিনের হৃদয়াকাশে আলোর ছটা ছড়িয়ে যাচ্ছে। এ বদর শুধুমাত্র একটি নাম বা ঘটনারই স্মারক নয় এটি হচ্ছে ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করা এক অনন্য উপাখ্যান। এটি হচ্ছে দিকভ্রান্ত ঝিমিয়ে পড়া মুমিন-মুসলমানের জন্য শ্রেষ্ঠতম চেতনার নাম। এটি লাঞ্চিত, নিগৃহীত ও বিজাতীয় চক্রান্তে নিষ্পেষিত মজলুম মুসলমানের জন্য প্রেরণার দীপ্তমশাল। জালিম, নিপীড়ক, চক্রান্তকারী, মানবতার দুশমন, শয়তান এবং তার প্রতিভূদের জন্য এক আতংকের নাম। যে ঘটনা পাল্টে দিয়েছে ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি এবং ধ্যান-ধারণা। করে দিয়েছে হক্ব-বাতিলের মধ্যে চূড়ান্ত পার্থক্য সত্য এবং ন্যায়ের বিজয় নিশ্চিত করার মাধ্যমে। যুগ যুগ ধরে প্রেরণা দিয়েছে মজলুম মুসলমানদেরকে সংখ্যায় স্বল্প হয়েও ঈমানী বলে বলীয়ান হয়ে, রাসূল প্রেমে সিক্ত হয়ে, বহুগুণ শক্তিশালী জালিমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। কেয়ামত পর্যন্ত অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্যের, জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমানের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে এ গাযওয়া।
হিজরী সনের দ্বিতীয় বর্ষ। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবেমাত্র নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্র ‘মদীনা মুনাওয়ারা’ পূণর্গঠনে ব্যস্ত। অন্যদিকে শত চেষ্টা, অত্যাচার-নির্যাতন করেও পবিত্র মক্কায় যখন মুশরিকরা ইসলাম ও নবীজীকে নিশ্চি‎‎হ্ন করতে ব্যর্থ হল এবং মুসলমানরা মদীনাতুন্নবীতে হিজরত করে চলে এলেন, তখন থেকেই কাফির-মুশরিকরা এ ষড়যন্ত্র শুরু করেছিলো যে, সন্ত্রাস ও সামরিক শক্তি বলে মুসলমানদের সামগ্রিক শক্তিকে নিশ্চি হ্ন ও নির্মূল করে দেবে। অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে মুসলিম শক্তিকে চিরতরে পদদলিত করে ফেলবে। অদ্বিতীয় রণকৌশলী ও বিচক্ষণ সেনা নায়ক হিসেবে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফিরদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য বিভিন্ন সময় তাঁর সাহাবীদেরকে গোয়েন্দা হিসেবে প্রেরণ করেন। প্রথমত হযরত আমীরে হামযা (রা:), এরপর একে একে উবায়দা ইবনুল হারিস, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা:) প্রমুখ সাহাবাদের নেতৃত্বে ছোট ছোট দলের গোয়েন্দা বাহিনী পাঠানো হয়। তারা সর্বক্ষণ কাফিরদের উপর নজর রাখছিলেন। অবশেষে বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যখন কাফির বাহিনী দূরাচার আবু জাহালের নেতৃত্বে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সংবাদ পেয়ে সাহাবাদের নিয়ে পরামর্শ সভায় বসেন। সেখানে বিস্তারিত বিষয় তুলে ধরে তাদের মতামত জানতে চান। সংখ্যায় অল্প ও অস্ত্র-শস্ত্রের অভাবের কারণে কোন কোন সাহাবী কিছুটা আপত্তি জানালেও হযরত মিকদাদ ইবনে আমর আনসারী (রা:) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনি যে নির্দেশ পেয়েছেন সেই মুতাবিক সওয়ারী প্রস্তুত করুন। আমরা তেমন কথা বলব না- বনী ইসরাইলগণ হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে যেমনি বলেছিল, ‘হে মূসা তুমি এবং তোমার প্রভূ গিয়ে যুদ্ধ করতে থাকো আমরা এখানেই বসে থাকবো।’ (সূরা মায়েদা-২৪) সেই মহান সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্য ও ন্যায় সহকারে প্রেরণ করেছেন। যদি আপনি ‘বারকুল গাম্মাদ’ (সুদূর ইয়ামানের একটি এলাকার নাম) পর্যন্ত যান তাহলে আমরাও আপনার সাথী হয়ে যাবো। অধিকন্তু আপনাকে মাঝখানে রেখে সামনে-পেছনে, ডানে-বাঁয়ে আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। এই বক্তব্য শুনে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চেহারা মুবারক রওশন হয়ে গেল। ইবনে মাসঊদ বলেন, মিকদাদের দ্বারা আমি এমন একটি দৃশ্য সংঘটিত হতে দেখেছি, তা যদি আমার দ্বারা সংঘটিত হতো, তবে দুনিয়ার সকল সম্পদের চাইতে ওটাই আমার কাছে অধিকতর প্রিয় হতো। তিনি বলেন আমি দেখলাম মিকদাদের এমন প্রাণস্পর্শী কথায় রাসূলুল্লাহর চেহারা হাস্যেজ্জ্বল হয়ে উঠেছে এবং তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছেন (বিদায়াহ নিহায়াহ)। সুবহানাল্লাহ! এভাবেই সাহাবায়ে কিরামগণ সব কিছুর বিনিময়ে প্রিয় হাবীবের নূরাণী চেহারায় একটু হাসি ফোটানো এবং তাঁর সন্তুষ্টিকেই একমাত্র লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে ও সৌভাগ্যের কারণ বলে মনে করতেন। আর এটিই হলো মূলত: ঈমান এবং মুসলমানদের বিজয় ও মুক্তির একমাত্র চাবিকাঠি। হযরত সা’দ ইবনে মুআয (রা:) আরয করলেন, সেই মহান সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্যনবী হিসাবে প্রেরণ করেছেন, আপনি যদি আমাদের উত্তাল সমুদ্র সাতরিয়ে অতিক্রম করতে বলেন তবে আমরা তাই করবো। আমাদের মধ্যে থেকে এক ব্যক্তিও আপনাকে ছেড়ে পেছনে পড়ে থাকবেনা। ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা যুদ্ধের ময়দানে অকুতোভয় সৈনিক এবং প্রতিপক্ষকে নিজেদের অঙ্গীকার বাস্তবে পরিণত করে দেখাতে পারদর্শী। আমি দৃঢ় প্রত্যয় পোষণ করছি যে, আমাদের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠাপূর্ণ খিদমতে আপনার নয়ন যুগল শীতল করবে। এ আবেগপূর্ণ বক্তব্য শ্রবণে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত আনন্দ ও প্রশান্তি প্রকাশ করলেন এবং ৩১৩ জনের মুষ্টিমেয় মর্দে মুজাহিদ রাসূলের পবিত্র ক্বদমে জীবন উৎসর্গকারী সাহাবীদের নিয়ে দুশনদের প্রতিহত করতে আল্লাহর নির্দেশে বের হয়ে পড়েন। ইরশাদ হচ্ছে : “যুদ্ধে অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে যাদের সাথে কাফেররা যুদ্ধ করে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম (সূরা হজ্ব-৩৯)।”
এখানে যে বিষয়টি লক্ষ্যনীয় সাহাবায়ে কিরাম চরম প্রতিকূল অবস্থায়ও পরিপূর্ণ ঈমান ও রাসূল প্রেমের যে দৃষ্টান্ত দেখাচ্ছিলেন তা এককথায় অতুলনীয়। এ সকল ঘটনা ও জীবন উৎসর্গীত বিষয়াবলীই যুগে যুগে বাতিলের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছে। একদিকে মুষ্টিমেয় ৩১৩ জন মুজাহিদ, ২টি ঘোড়া, ৬০টি বর্ম, ৭০টি উট, গুটিকয়েক তীর-তলোয়ার অস্ত্র-শস্ত্র, অধিকাংশই প্রায় নিরস্ত্র, কারো কারো গায়ে শুধুমাত্র লজ্জাস্থান ঢাকার মত কাপড়, প্রয়োজনীয় খাদ্য ও রসদের অপ্রতুলতা, প্রশিক্ষণবিহীন কিন্তু প্রিয় রাসূলের মহব্বতে বিভোর অমিততেজী মুসলিম বাহিনী। যাদের একমাত্র সম্বল হলো আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুল ও নিখাঁদ নবী প্রেম। অন্যদিকে মুশরিক বাহিনীর সংখ্যা হচ্ছে প্রায় ১০০০, ২০০টি ঘোড়া (বিদায়াহ নিহায়াহ), অসংখ্য উট, সে যুগের সর্বাধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র, ৬০০টি বর্ম, কিছু নর্তকী-গায়িকা, বিপুল পরিমাণ খাদ্য-পানীয় ও রসদ, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সেনাবাহিনী। সার্বিক বিবেচনায় মুসলিম বাহিনীর চেয়ে দ্বিগুনেরও বেশী শক্তিশালী। ইতিহাসে এ এক অসম যুদ্ধ। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদর প্রান্তরেই মহান আল্লাহর দরবারে সিজদায় পড়ে গেলেন। রোনাজারী করে আল্লাহর সাহায্য চাইতে লাগলেন। অত:পর সিজদা থেকে মাথা তুলে এমন অশ্র“ বিসর্জন, একাগ্রতা ও বিনয় সহকারে দু’আ করতে থাকেন যে, তাঁর গায়ের চাদর মোবারক কাঁধ থেকে নিচে পড়ে যায়। তখন হযরত আবূ বকর সিদ্দিক (রা:) হুজুরকে শান্তনা দিয়ে বলেন, আল্লাহ তায়ালা তো আপনার বিজয় ও সাফল্যের ওয়াদা-ই করেছেন।
ইত্যবসরে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটু তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়েন। সমগ্র মুসলিম ফৌজও তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। একটু পরে নবীয়ে দোজাঁহা চোখ খুলতেই বললেন, হে আবূ বকর! তোমার জন্য সুসংবাদ! আল্লাহ তায়ালার সাহায্য এসে গেছে। পবিত্র কুরআনের সূরা আনফালের ৯ নং, এবং সূরা আলে ইমরানের ১২৪ ও ১২৫ নং আয়াতের ভাষ্য অনুযায়ী প্রথমে এক হাজার, পরবর্তীতে তিন হাজার ও সর্বশেষ পাঁচ হাজার ফেরেশতা মুসলিম বাহিনীর সাহায্যে আল্লাহ তায়ালা পাঠিয়ে ছিলেন। মুজাহিদবৃন্দ চোখ মেলে দেখতে পেলেন যে, শত্র“ বাহিনীর সংখ্যা খুবই নগন্য এবং মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই দৃশ্য অবলোকন করে তাদের প্রত্যয়, শক্তি, সাহস ও উদ্যম শতগুণে বেড়ে গেল। অবশেষে ঐতিহাসিক বদর প্রান্তরে উভয় পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করলো। প্রথমে মল্লযুদ্ধ শুরু হলো। কাফিরদের মধ্যে থেকে আসওয়াদ মাখযূমী বেরিয়ে এলে হজরত হামযা (রা:) তাকে এক আঘাতেই খতম করে দেন। এরপর একে একে উতবা, শাইবা এবং ওয়ালিদ এগিয়ে আসলে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীতায় হজরত উবাইদাহ, হামযাহ ও আলী (রা:) অগ্রসর হয়ে তাদেরকে পরাস্ত ও নিহত করেন। কাফির বাহিনী থেকে আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর (তিনি তখনো ইসলাম গ্রহণ করেন নি) প্রতিদ্বন্দ্বী তলব করলে তার দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়ার জন্য জন্মদাতা পিতা আবূ বকর সিদ্দিক (রা:) তৈরী হয়ে গেলেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে থামিয়ে দিলেন। জাররাহ বেরিয়ে আসলে তারই গর্ভজাত আপন সন্তান আবু উবায়দা (রা:) প্রতিদ্বন্দ্বীতায় এগিয়ে আসেন। ভাবা যায়? এ কোন শক্তি? কোন প্রেরণায় পুত্রের বিরুদ্ধে পিতা কিংবা পিতার বিরুদ্ধে পুত্র, ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই, এমনকি অল্প বয়সী কিশোর যারা তলোয়ার পর্যন্ত ঠিকমত ধরতে পারেননা তরবারী হাতে নেমে আসলেন। নরপিচাশ আবূ জাহালকে জাহান্নামের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া ছোট দুই ভাই মুআয ও মুআওয়ায (রা:) তারা সাত ভাই যুদ্ধের ময়দানে এসেছিলেন। এভাবেই সাহাবায়ে কিরাম নিজেদের সবকিছু হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র ক্বদমে উৎসর্গ করেছিলেন। তুমুল যুদ্ধ শেষে প্রায় নিরস্ত্র মুসলমানদের হাতে আল্লাহর সাহায্যে কাফির-মুশরিক বাহিনী চরম পর্যদূস্ত ও পরাজিত হয়। তাদের ৭০জন নেতৃস্থানীয় নেতা নিহত ও ৭০জন বন্দী হয়। এদিকে মুসলিম বাহিনীর কেবল মাত্র চৌদ্দজন মুজাহিদ শাহাদাতের গৌরব অর্জন করেন। এদের মধ্যে ৬জন মুহাজির ও ৮জন আনসার সাহাবী। সর্বপ্রথম শাহাদাতের অমীয় সূধা পান করেন হযরত মাহজা (রা:)। ইনি হযরত উমর ফারুক (রা:) এর ক্রীতদাস ছিলেন এবং বিশ্ববাসীর নিকট তিনি ক্রীতদাস হিসাবেই পরিচিত অথচ বিশ্বজনীন সাম্য-মৈত্রী প্রতিষ্ঠাতা ইনসাফ ও ন্যায়ের পতাকাবাহী; সার্বজনীন ভ্রাতৃত্বের উৎস সরোয়ারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ‘সায়্যিদুশ শুহাদা’ (শহীদ শ্রেষ্ঠ) বলে খেতাব দান করেছেন। এ যুদ্ধে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসংখ্য মু’জিযা প্রকাশিত হয়েছিল, তন্মধ্যে যুদ্ধের আগে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদর প্রান্তরে সাহাবাদেরকে দেখাচ্ছিলেন এখানে অমুক কাফির, ওখানে অমুক কাফির নিহত হয়ে পড়ে থাকবে। যুদ্ধের শেষে দেখা গেল যে রাবী বলেন, আল্লাহর শপথ! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চিহ্নিত স্থানগুলো তাদের কেউই অতিক্রম করেনি (মুসনাদে আহমদ-৩/২১৯)। যার জন্য যেই স্থান চিহ্নিত করেছিলেন, সে সেই স্থানেই নিহত হয়েছে। এটি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আল্লাহ প্রদত্ত ইলমে গায়েবের অকাট্য উদাহরণ। হযরত উক্কাশা বিন মিহসান (রা:) বলেন, যুদ্ধের এক পর্যায়ে আমার তলোয়ার ভেঙ্গে যায়, অত:পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে এক খন্ড কাষ্ঠ দেন হঠাৎ দেখি তা একটি লম্বা ঝকঝকে তলোয়ারে পরিণত হলো। আমি তা দিয়ে মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকি। এবং মৃত্যু পর্যন্ত এ তলোয়ার তার কাছে ছিল (দালাইলুন নবুওয়াহ লিল বায়হাক্বী-৩/৯৯)। হযরত কাতাদা ইবনে নু’মান (রা:) বলেন, যুদ্ধে তার চোখে দারুনভাবে আঘাত লাগে এর ফলে তার চোখের পুতুলী বের হয়ে ঝুলতে থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার চোখ ধরে আবার যথা স্থানে বসিয়ে দেন। এতে তার চোখ এত ভালো হয়ে যায় যে, তিনি বুঝতেই পারতেন না তার কোন চোখে আঘাত লেগেছিল (বিদায়াহ নিহায়াহ-৩/২৯১)। সুবহানাল্লাহ! আমার প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে আমাদের মত সাধারণ মানুষ নন এগুলো তারই উৎকৃষ্ট প্রমাণ। আফসোস! মুসলমান ভুলে গেছে তাদের এই স্বর্ণালী ইতিহাস। হারিয়ে ফেলেছে জালিমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেতনা ও সাহস। তাদের অন্তরে নেই নিখাঁদ নবী প্রেম। তারা ভুলে গেছে নবীজীর অমীয় বাণী “নিশ্চয়ই জান্নাত তরবারীর ছায়াতলে” (সহিহ বুখারী-৩/১০৩৭)। বিস্মৃত হয়েছে প্রিয় রাসূলের পবিত্র বাণী “যে লোক মরে গেল, কিন্তু যুদ্ধ বা জিহাদ করল না- জিহাদ করার কোন ইচ্ছাও তার মনে জাগেনি, সে মুনাফিকীর একটি অংশ নিয়েই মরলো” (সহিহ মুসলিম-৬/৪৯)। নাঊযুবিল্লাহ! তাই আজকে দুনিয়ার দিকে দিকে বিজাতীয় ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের কারণে চরম লাঞ্চিত, ধিকৃত, নির্যাতনে নিষ্পেষিত মজলুম মুসলিম উম্মাহর হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন বদরের চেতনায় উজ্জীবিত একদল মর্দে মুজাহিদ যারা আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করবেনা, যারা হবে রাসূল প্রেমে প্রাণ উৎসর্গকারী, অন্যায়-অসত্যের সাথে করবেনা কোন আপোষ। নিজেদের জান-মাল কোরবান করবে কামলিওয়ালার নূরাণী ক্বদমে। যাদের প্রত্যয় হবে ‘শির দেগা নেহী দেগা আমামা’। তবেই অন্ধকার কেটে গিয়ে মুক্তির সুবহে সাদেক প্রকাশ পাবে। বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য, শান্তি, ন্যায়-ইনসাফ ও মানবতা। আল্লাহ জাল্লা শানুহু আমাদের কবুল করুন। মুক্তির সোনালী সূর্য দেখে যেন শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করতে পারি মাওলার দরবারে করজোড়ে এই মিনতি পেশ করছি। আমিন। বি জাহি সায়্যিদিল মুরসালীন।

হযরত গাউছুল আ’জম মহিউদ্দিন আব্দুল ক্বাদের জিলানী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)
আয়েশা আখতার আযহারী
কামিল ২য় বর্ষ (হাদীস), গাজীমুড়া আলীয়া মাদ্রাসা, লাকসাম

পূর্ব প্রকাশের পর:
নিম্নে বর্ণনা করবো হুজুর গাউছে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর আক্বীদার মূলনীতি সমূহ:
আমরা কার অনুসারী:
اعتقادنا اعتقاد السلف الصالح والصحابة(سير أعلام النبلاء-২০ ج ص২৪৪)
অর্থাৎ:- আমাদের আক্বীদা হলো সালফে সালেহীন এবং সাহাবগণের আক্বীদা। (সিয়ারু অ’লামিন নুবালা ২০ খন্ড, ২৪৪পৃ:) সালফে সালেহীনের যুগ হলো ৫০০ হিজরী পর্যন্ত। আবার কারো কারো মতে ৩০০ হিজরী পর্যন্ত। তবে ক্ষেত্রে ৫০০ হিজরী পর্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। (জাওহারাতুত্ তাওহীদ)
হুজুর গাউছে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ঈমানের পরিচয়:
نعتقد أن الايمان قول باللسان ومعرفة بالجنان وعمل بالأركان-يزيد بالطاعة وينقص بالعصيان ويقوي بالعلم ويضعف بالجهل (الغنية ج১-ص৬২)
আমরা বিশ্বাস করি নিশ্চয় ঈমান হলো-মৌখিক স্বীকৃতি, আত্মিক পরিচিতি, এবং আবশ্যিক আমল করা। ঈমান আমল দ্বারা বৃদ্বি পায় এবং গুনাহের কাজ দ্বারা কমে যায়, ইলম দ্বারা ঈমান দৃঢ় হয় এবং মূর্খতা দ্বারা দূর্বল হয়। এ রায়টি হাম্বলী মাজহাবসহ তিন মাজহাবের। আর হানাফী মাজহাব মতে, ঈমান হলো-আত্মিক স্বীকৃতির নাম, যা বাড়ে-কমে না। বরং নেক আমল দ্বারা ঈমান পূর্ণতা হয় কারণ আমল ঈমানের অংশ না। মূলত গাউছে পাক হাম্বলী মাজহাবের অনুসারী ছিলেন এছাড়াও সময়ের দিক বিবেচনায় তিনি ছিলেন সালফে সালেহীনগণের মধ্যমণি। (গুনিয়াতুত্তালেবীন ২য় খন্ড, ৬২ পৃষ্ঠা:)



আমাদের অনুসরণের মূল ভিত্তি কি হবে:
لا نخرج عن الكتاب والسنة-نقرأ الأية والخبر ونؤمن بما فيها ونكل الكيفية في الصفات الي علم الله عز وجل (الغنية
অর্থাৎ- আমরা অনুসরণের দিক থেকে কুরআন ও হাদীসের হতে বাহির হবনা, আমরা কুরআনে বর্ণিত আয়াত ও হাদীস পড়ব এবং আমরা উহাতে যেভাবে আছে অনুরূপ বিশ্বাস করব এবং বর্ণিত সিফাতসমূহের ধরণ সর্ম্পকে আল্লাহ আয্যা ওয়া জাল্লার ইলমে সোপর্দ করব। সিফাত মূলত ঐ সমস্ত সিফাত ও হাদীসসমূহ যা বুঝতে দূবোধ্য হয় বা যে গুলো মুতাশাবিহার অর্ন্তভুক্ত যথা: يد الله (ইয়াদুল্লাহ), استواء علي العرش (ইস্তাওয়া আ’লাল আরস), وسع كرسي (কুরসি), واصنع الفلك علي عيني (আইনান), যথা: হাদীসে পাকে এসেছে ربنا ينزل বা نزول সহ এসমস্ত আয়াত - হাদীসসমূহ সর্ম্পকে চারটি মাজহাব ১. মাজহাবে তাফবীদ (تفويض) নিজস্ব কোন বক্তব্য নয় বরং সর্বাবস্তায় আল্লাহর নিকট সোপর্দ করতে হবে মূলত গাউছে পাক ছিলেন সালফে সালেহীনগণের মধ্যে। তাই সালফে সালেহীনগণ তাফবীদ মাজহাবটির অনুসারী ছিলেন।
২. মাজহাবে তাওয়াক্কুফ توقف)) সর্ম্পকে কেউ কিছু বললে চুপ থাকা, এসমস্ত আয়াতসমূহ সর্ম্পকে চুপ থাকবে।
৩. মাজহাবে তা ’বীল (تأويل) এসমস্ত আয়াতসমূহ তার মূল উদ্দেশ্য ঠিক রেখে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করবে। এটি মুতাআখখিরীন ইমামগণের মাজহাব। এ তিনটি মাজহাব আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’ত এর অন্তর্ভূক্ত। মাজহাবে তা’বীলের মধ্যে একটি বাতেল যেটি আয়াতের এবং হাদীসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মূল উদ্দেশ্যের বাইরে চলে যায়। যেমন: মু’তাজিলা সম্প্রদায়।
৪. মাজহাবে বাতেল: উক্ত মাজহাবটি বলবে যে, তারা তাফবীদে আছে অথচ তারা এ বাড়াবাড়ি করে যে, আল্লাহর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সাব্যস্ত করে। আর এটি হল মুশাব্বিহা বা মুজাস্সামিয়া এরা ইসলামে চরমপন্থী বর্তমান যারা নিজেদেরকে সালফে সালেহীনগণের পূর্ণ অনুসারী মনে করে এবং নিজেদেরকে সালাফী বা আহলে হাদীস নামে পরিচয় দেয়। আর এরাই ওয়াহাবী।
لا فلاح لك حتي تتبع الكتاب والسنة
কোন সফলতা নেই যতক্ষন না কুরআন ও হাদীসে পাকের পূর্ণ অনুসরণ করবে।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’তের উপর মৃত্যু কামনা করা:
أمتنا علي مذهه أصلا وفرعا وحشرنا في زمرته(الغنية-ج১-৫৫
হে আল্লাহ আমাদেরকে মৃত্যুদান কর ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর অসলি-ফারয়ি’ (মৌলিকত্ব ও শাখা) মতবাদ মানার উপর এবং অবশেষে তাঁর যামরার নিচে হাশর-নশর কর। আমীন। গাউছে পাক ছিলেন ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মাজহাবের অনুসারী তাই তিনি খাস করে উক্ত দোআ” করেছেন এখানে কত বড় শিক্ষা আমাদের জন্য যে, তিনি কিভাবে মাজহাব মানতেন। তাই তাদের জবাব যারা বড় বুযুর্গ সেজে মাজহাব মানতে চায় না।
বিদ্আতের অনুসরণ না করা:
ويقول: عليكم بالاتباع من غير ابتداع عليكم بمذهب السلف الصالح (الفتح الرباني-المجلس العاشر ص ২৩)
তিনি আরো বলেন: অবশ্যই তোমাদের উপর কোনরূপ নতুন ছাড়াই সঠিক অনুসরণ করা এবং অবশ্যই তোমাদের উপর সালফে সালেহীনগণের পূর্ণ অনুসরণ করা ফরজ। (ফাত্হুর রাব্বানী, মাজলিস ১০, পৃষ্ঠা-২৩)
কুরআন ও হাদীসের অপব্যাখ্যা হতে পানাহ চাওয়া:
نعوذ باالله من أن نقول فيه وصفاته مالم يخبرنا به أورسوله صلي الله عليه وسلم (الغنية-১ج-ص৫৭)
তিনি আরো বলেন: আমরা আল্লাহর নিকট পানাহ চাই সিফাতসমূহ (আয়াতে মুতাশাবিহাত ও হাদীসে মুশাবিহ) সর্ম্পকে এমন কথা বলা থেকে যে গুলো সর্ম্পকে আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সংবাদ দেন নাই। (চলবে)

প্রশ্নোত্তর পর্ব:
জবাব দিচ্ছেন- মাও. মুফতি ফজলুল কা¡দের আল্-ক্বাদেরী
আরবী প্রভাষক, গাজীপুর (হরিপুর) নেছারিয়া ফাযিল মাদরাসা, চাঁদপুর

প্রশ্ন: তেলাওয়াতে সিজদা কি? তেলাওয়াতে সিজদা আদায়ের নিয়ম ও হুকুম কি?
তেলাওয়াতে সিজদা কি?
    পবিত্র কুরআনে এমন ১৪ টি আয়াত রয়েছে যে গুলো তেলায়াত করলে অথবা অন্যকে তেলাওয়াত করতে শুনলে সিজদা আদায় করা ওয়াজিব হয়ে যায়। এরূপ কোন আয়াত তেলাওয়াত করে বা শুনে সিজদা করাকে তেলাওয়াতে সিজদা বলে।
তেলাওয়াতে সিজদার নিয়ম :
    যে সিজদার আয়াতটি তেলাওয়াত করে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে সিজদায় যাবে এবং তিন বার সিজদার তাসবীহ পড়ে পুনরায়‘আল্লাহু আকবার’ বলে দাঁড়াবে। হাত উঠাতে বা বাধতে হবেনা। এবং দু’সিজদা করতে হবেনা। আর দাঁড়াতে অক্ষম হলে বসে দিবে।
    নামাযে সিজদার আয়াত পড়লে আয়াতটি পড়েই আল্লাহু অকবার বলে অনুরূপ একটি সিজদা করবে আবার আললাহু আকবার বলে দাঁড়িয়ে বাকী ক্বিরাত পড়বে এবং নামাযের নিয়ম অনুযায়ী নামায শেষ করবে।
তেলাওয়াতে সিজদার হুকুম:
    প্রত্যেক সুস্থ্য মস্তিস্কধারী এবং প্রাপ্ত বয়স্কের উপর সিজদা করা ওয়াজিব।
    নমাযের ভিতরের সিজদা নামাযে না করে নামাযের বাইরে করলে আদায় হবে না (আলমগীরী)
    যদি কোন মুকতাদী ইক্তিদা অবস্থায় সিজদার আয়াত তেলাওয়াত করে তাহলে অন্যান্য মুক্তাদী ও ইমাম কারো উপর সিজদা ওয়াজিব হয়না। হ্যাঁ যদি ঐ ব্যাক্তির কাছ থেকে সালাতের বাইরে কেউ শুনে তবে তার উপর সিজদা ওয়াজিব হবে। (আলমগীরী)
    যদি কেউ সালাতের ভিতর সিজদার আয়াত পড়ে এবং এ সিজদাটি আদায়ের পূর্বে সালাত ভেঙ্গে যায় তাহলে তা সালাতের বাইরে আদায় করে নিবে, কেননা যখন সালাত ভেঙ্গে গেল তখন সেজদাটি শুধুমাত্র তেলাওয়াতের সেজদা হিসাবে রয়ে গেল। সালাতের সেজদা থাকলনা (আদ্দুররুল মুখতার)
    যদি কেউ ইমাম থেকে সিজদার আয়াত শুনে, তারপর ঐ সালাতেই সে ঐ ইমামের ইক্তিদা করে তবে সে ব্যাক্তি যদি দ্বিতীয় রাকাতে ইক্তিদা করে আর ইমাম প্রথম রাকাতে সিজদার আয়াত পড়ে থাকেন তবে সালাতের পর সিজদা করবে। আর যদি ঐ রাকাতেই ইক্তিদা করে যে রাকাতে সিজদার আয়াত পড়া হয়নি, তবে সে ইমামের সাথে সিজদা করবে। আর যদি ইমামের সিজদা করার পর ঐ রাকাতেই সে ইক্তিদা করে তবে সে আর সিজদা করবেনা। সালাতের ভিতরেও না বাইরেও না (আলমগীরি)
    এক ব্যাক্তি একই আয়াত আসতেও পড়ল আবার যেতেও পড়ল কিন্তু শ্রবণকারী একই বৈঠকে থেকে তা শ্রবণ করল। এমতাবস্তায় পাঠকারী দু’সিজদা আর শ্রবণকারী এক সিজদা আদায়করবে (আলমগীরী)
    যদি কোন হানাফি মাযহাব অনুসারি ব্যাক্তি কোন শাফেয়ী মাযহাবের ইমামের পিছনে ইক্তিদা করে, ইমাম সাহেব এমন সিজদার আয়াত তেলাওয়াত করে সিজদায় গেলেন যে সিজদার আয়াতটি হানাফীদের নিকট ওয়াজিব নয়, এমতাবস্তায় শুধু ইমামের অনুসরণে সিজদা করবে কিন্ত ওয়াজিব সিজদা হিসাবে নয়। বি:দ্র: এ জন্য সিজদার আয়াতসমূহ জানা আবশ্যক
    যদি কোন হানাফী ব্যাক্তি কোন মালেকী ইমামের পিছনে ইক্তিদা করে অত:পর যেখানে হানাফী নিয়মে সিজদায়ে তেলাওয়াত রয়েছে কিন্তু মালেকী ইমাম সিজদা দেয় নাই তবে মুক্তাদি ও দিতে হবেনা। এমনকি হানাফী ইমামও যদি সিজদা না আদায় করে তবে মুক্তাদিও সিজদা না করে ইমামের অনুসরণ করবে। (গায়াতুল আওতার) যাদের উপর সিজদার আয়াত পাঠ করলে বা শুনলে সিজদা ওয়াজিব হয়না তারা হচ্ছে : (১) কাফির, (২) পাগল, (৩) অপ্রাপ্ত বয়স্ক (৪) ঋতুবর্তী মহিলা। যদি এদের কারো কাছ থেকে সিজদার তেলাওয়া শুনে তাহলে শ্রবণকারীর উপর সিজদা ওয়াজিব হবে। (দুররুল মুখতার)
প্রশ্ন: রোযা অবস্থায় ইনজেকশান, ইনহেলার, ইনসুলিন ডোজ ব্যবহার এবং নাক, কান ও চোখে ড্রপ ব্যবহার করলে রোজা নষ্ট হবে কিনা? শরীয়তের দৃষ্টিতে জবাব দিয়ে বাধিত করবেন।
জবাব: রোযা অবস্থায় ইনজেকশান ব্যাবহার করলে রোযা নষ্ট হবে কিনা এ ব্যপারে ওয়ালামায়ে কিরামগণ ভিন্ন ভিন্ন মত দিলেও রোযা অবস্তায় ইনজেকশান ব্যবহার না করাই নিরাপদ ও রোযা নষ্ট না হওয়ার আশংকা মুক্ত থাকে। তদ্রƒপ যে সব রোগীরা ইনহেলার ব্যবহার ব্যতীত রোযা রাখা সম্ভব না তারা ঐ সমস্ত রোযা যে গুলোতে ইনহেলার ব্যবহার করেছে রোযার পরে তার ক্বাযা আদায় করতে হবে, তাতে কাফ্ফারা লাগবেনা। তবে যে সব রোযায় ইনহেলার ব্যবহৃত হয়েছে তা ভঙ্গ করতে পারবে না। ভঙ্গ করলে কাফ্ফারাসহ আদায় করতে হবে। যদি রমযানের পর সুস্থ্য না হয়ে দীর্ঘ মেয়াদি হয়ে যায় তবে প্রতিটি রোযার ফিদ্য়িা / কাফ্ফারা প্রদান করবে। ইনসুলিন সাধারণত ডায়াবেটিস রোগীরা আহারের কিছুক্ষণ পূর্বে ব্যবহার করে থাকেন যা রোযা অবস্তায় ব্যবহার করলে রোযা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে তাই ইনসুলিন ইফতারের মূহুর্তে নিয়ে কিছুক্ষণ পর ইফতার সামগ্রী আহার করবেন। তদ্রূূূপ মলদারে ডোজ ব্যবহার, নাক, কান ও চোখে ড্রপ ব্যবহারে রোযা নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে তাই রোযা অবস্তায় এগুলো হতে বিরত থাকা আবশ্যক। তদুপরি ডোজ, ড্রপ ইফতারের পরে ব্যবহার করা উত্তম। এছাড়া ভালো মুসলিম ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সন্ধ্যার পর থেকে যে কোন ঔষধ ব্যবহার করা উচিত।
প্রশ্ন: একাকি বা জামা’তে নামায আদায়কালীন মোবাইল রিং বেজে উঠলে তার হুকুম কি?
যে কাজ করতে দু’হাত ব্যবহৃত হয় বা একই কাজ বারবার পুনরাবৃত্তি হয় তা হল আমলে কাছির এ ধরণের যে কোন আমল নামায বাতিল করে দেয়। যে কাজ করতে এক হাত ব্যবহৃত হয়, এবং কোন কাজ বারংবার পনুরাবৃত্তি হয়না তা হল আমলে কালিল। আমলে কালিল দ্বারা নামাজ বাতিল হয়না। তাই ফোকাহায়ে কিরামগণের উক্ত আমলে কালিল কায়েদার আলোকে কেই যদি নামাযে এক হাত দ্বারা মোবাইল বন্ধ করে নেয় তবে নামাযের কোন ক্ষতি হবেনা। আর যদি বারবার করতে যায় তবে তা আমলে কাছির হবে এতে নামায বাতিল হবে। তাই একজন নামাজি ব্যক্তির কর্তব্য কাজ হল নামাযের পূর্বে পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়া। যাতে করে নামায আদায়ে পূর্ণ শুদ্বতা বজায় থাকে। নামাযে আমলে কাছির ও আমলে কালিল সংক্রান্ত মাসআলা সমূহ শরহুল বেকায়া ও ফাতয়ায়ে হিন্দিয়া সহ বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য কিতাবে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
প্রশ্ন: ইমাম যদি তারাবীহের ২য় রাকা’তে না বসে ৩য় রাকা’তের জন্য দাড়িয়ে যান এবং ৪র্থ রাকা’তও পড়ে ফেলেন তাহলে কি সাহু সিজদা ওয়াজিব হবে কিনা?
জবাব: ইমাম যদি তারাবীহের ২য় রাকা’তে না বসে ৩য় রাকা’তের জন্য দাঁড়িয়ে যান এবং ৪র্থ রাকা’তও পড়ে পেলেন তাহলে কি সাহু সিজদা ওয়াজিব হবে। এমতাবস্তায় ১ম দু’রাকা’ত পড়ে শেষ বৈঠক না করার কারণে নামায ফাসিদ হবে। এবং প্রথম দু’রাকা’ত কিরাত সহ পুনরায় আদায় করতে হবে কিন্তু পরের দু’রাকা’ত ক্বিরাত সহ আদায় হয়ে যাবে। (ক্বাবীরী)
প্রশ্ন: তারাবীহ নামাযে ইমাম সাহেব চুপিচুপি ক্বিরাত পড়তে থাকলে তার হুকুম কি?
জবাব: তারাবীহের নামাযে ইমাম সাহেব চুপিচুপি ক্বিরাত পড়লে তা যদি ছোট তিন আয়াত পরিমাণের বেশি হয় তবে সাহু সিজদা দিতে হবে (ক্বাবীরী ৩৯০)
প্রশ্ন: ইমাম সাহেব ক্বিরাত ভুলে যদি নামাযে চিন্তা করেন তাহলে নামায ভঙ্গ হবে কিনা?
জবাব: ইমাম সাহেব যদি ক্বিরাত ভুলে গিয়ে বৈঠকে বা দাঁড়িয়ে চিন্তা করেন এমতাবস্তায় উক্ত চিন্তার সময়টি এক রুকন (৩ তাসবীহ) পরিমাণ হয় তাহলে সাহু সিজদা ওয়াজিব হবে (শামী ১ম খন্ড ৫০৬ পৃ:)
প্রশ্ন: তারাবীহ পড়ানোর সময় ইমাম সাহেব ভুলে ১ম রাকা’তেই বসে গেলেন, লোকমা পাওয়ার সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলেন এ ক্ষেত্রে হুকুম কি?
জবাব: তারাবীহ পড়ানোর সময় ইমাম সাহেব ভুলে ১ম রাকা’তেই বসে গেলেন, লোকমা পাওয়ার সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলেন এমতাবস্তায় তিনি যদি এক রুকন বা ৩ তাসবীহ পরিমাণের কম সময় বসেন তবে সাহু সিজদা ওয়াজিব হবেনা। আর যদি ৩ তাসবী পরিমাণ বসে তবে সাহু সিজদা ওয়াজিব হবে। (শামী ১ম খন্ড, ৩০২ পৃ)।
প্রশ্ন: সাহু সিজদা আদায়ের নিয়ম জানতে চাই।
জবাব: হানাফী মাযহাব মতে সাহু সিজদা আদায়ের নিয়ম হল- শেষ বৈঠকে তাশাহুদ বা ‘আবদুহু ওয়া রাসূলুহু’ পড়ে ডান দিকে এক সালাম দিয়ে দু’টি সিজদা করবেন। অত:পর তাশাহুদ, দুরুদ শরীফ, দোয়া’য়ে মাছুরা পড়ে সালাম ফিরিয়ে নামায শেষ করবেন। (আলমগীরী ১ম খন্ড, ৬৫পৃ:)
প্রশ্ন: কোন সময় কি কারণে সাহু সিজদা করা ওয়াজিব?
জবাব: সালাতের যে কোন ওয়াজিব ছুটে গেলে সাহু সিজদা ওয়াজিব হবে। এজন্য প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্কদের উপর নামাযের ফরজ, ওয়াজিব গুলো জানা ফরজ। (নামাযে কোন ফরজ ছুটে গেলে সাহু সিজদা নয় বরং নামায ফাসিদ বা নষ্ট হবে) নিম্নে ওয়াজিব সমূহ-
চার রাকা’ত বিশিষ্ট নামাযে দু’রাকাতের বৈঠক না করলে, ১ম বৈঠকে দরুদ শরীফ ‘আ’লা মুহাম্মদ” পর্যন্ত পড়ে ফেললে, দু’রুকুর মাঝে ১ তাসবীহ পরিমাণ সোজা হয়ে না দাঁড়ালে এমনিভাবে দু’সিজদার মাঝে ১ তাসবীহ পরিমাণ না বসলে, বিতিরের দোয়ায়ে কুনুত না পড়লে, নামাযে যদি তেলাওয়াতে সিজদা থাকে, আর তা না দিলে, নামায আদায়কারী ভুলে দাঁড়ানোর স্থলে বসে; বসার স্থলে দাঁড়িয়ে থাকলে। ইমাম সাহেব মাগরীব, এশা এবং ফজরের নামযে উচ্চ আওয়াজে ক্বিরাত না পড়লে জোহর, আছরের নামাযে উচ্চ আওয়াজে ক্বিরাত পড়লে।

1 comment:

  1. Casino Junket Casino Online | JT Hub
    The casino 경주 출장마사지 offers players a wide selection of games to enjoy in its sleek lobby, 세종특별자치 출장안마 with slots and 하남 출장샵 table games like Blackjack, 시흥 출장안마 Craps, Roulette and 익산 출장샵

    ReplyDelete