Tuesday, July 1, 2014

শানে মহিউদ্দিন ১ম সংখা


নূরুল ইরফান ফি তাফসীরলি কুরআন
ড. মাওলানা এ, কে, এম মাহবুবুর রহমান
অধ্যক্ষ, ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদরাসা, যুগ্ন মহাসচিব, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন


بسم الله الرحمن الرحيم
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ (العلق : ১)
আল কুরআনের তাফসীর করা কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এ মহা বিজ্ঞানময় কুরআনের তাফসীর করার একমাত্র ক্ষমতা প্রিয়নবীকে মহান আল্লাহ তায়ালা দান করেছেন। ঘোষণা দিয়েছেন- إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ [القيامة : ১৯] আমারই দায়িত্ব এর বয়ান বা বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করা। তাই দয়াল নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল কুরআনের শব্দ ও বাক্যের যে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন তা ই তাফসীর। যার ফলে বোখারী, তিরমিযি শরীফ সহ বহু হাদীস গ্রন্থ كتاب التفسير- (কিতাবুত তাফসীর) বা তাফসীর অধ্যায় রয়েছে। এ কারণে দুনিয়ায় আরবী ভাষায় কুরআন ব্যাখ্যার যত গ্রন্থ রচিত হয়েছে সবগুলোই تأويل (তাবীল) নামে অভিহিত। তাই প্রিয় নবীজির প্রদত্ত ব্যাখ্যা, ভাষাবিদ ও কুরআন বিশারদগণের তাবীল মিলিয়ে কুরআন বুঝার যে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা-ই তাফসীরুল কুরআন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বিশ্ববিখ্যাত কুরআন গবেষকগণ এ কুরআন নিয়ে কথা বলা বা লেখার জন্য নূন্যতম যোগ্যতা কি হওয়া উচিত তার বিশদ আলোচনা করেছেন। তাদের নির্ধারিত জ্ঞান সমূহ না থাকলে কুরআন মজিদ নিয়ে কথা বলা বা লেখা ধৃষ্টতার শামিল। কুরআনের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে হলে জানতে হবে:-
১। ইলমুল লুগাহ علم اللغة))- ভাষা জ্ঞান
২। ইলমুস সরফ (علم الصرف) আরবী শব্দ প্রকরণ সম্পর্কীয় জ্ঞান
৩। ইলমুন নাহু (علم النحو) আরবী বাক্য প্রকরণ সম্পর্কীয় জ্ঞান
৪। ইলমুল ইশতিকাক (علم الاشتقاق) শব্দের ব্যুৎপত্তিগত জ্ঞান
৫। ইলমুল মা’আনী (علم المعانى) শাব্দিক অলংকরণ
৬। ইলমুল বয়ান (علم البيان) বাক্য প্রয়োগ অলংকরণ   
৭। ইলমুল বদী (علم البديع) ছন্দ প্রয়োগ অলংকরণ
৮। ইলমুল কিরাআত (علم القرأة) আল কুরআন পঠনরীতি জ্ঞান
৯। উছুলুদ্দীন (علم اصول الدين) দীনের মৌলিক ভিত্তি ও মূলনীতির জ্ঞান
১০। উসুলুল ফিকহ (علم اصول الفقه) ফিকহের মূলনীতির জ্ঞান
১১। আসবাবুন নুযূল ওয়াল কাসাস (اسباب النزول و القصص) সুরা ও আয়াত সমূহ নাযিল হওয়ার কাল-প্রেক্ষিত, কারণ ও ঘটনাবলীর সম্পর্কীত জ্ঞান।
১২। আন নাসিখ ওয়াল মানসূখ (الناسخ و المنسوخ) রহিতকারী আয়াত ও রহিত আয়াত সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ
১৩। ইলমুল ফিকহ (علم الفقه) আইন বিষয়ক জ্ঞান
১৪। উলুমুল হাদীস (علوم الحديث) হাদীস সম্পর্কীয় জ্ঞান
১৫। ইলমুল মাওহাবাহ (علم الموهبة) আল্লাহ প্রদত্ত সরাসরি জ্ঞান যার অপর নাম ইলমুল লাদুন্নী (علم اللدنى)
১৬। আল্লাহর যাত, সিফাত, হুকুম ও ইখতিয়ার সম্পর্কে (علم الذات و الصفات و الحكم و اختيارات الله) আল্লাহর সত্ত্বা, গুণাবলী, হুকুম-আহকাম ও ক্ষমতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ।
১৭। কুরআন নাযিলের স্থান-কাল সম্পর্কে জ্ঞান (علم الزمان و المكان لنزول القران)
১৮। উলুমুল কুরআন (علوم القران) তথা কুরআন বুঝার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানের শাখা সম্পর্কে জানা
১৯। ইলমুত তাওয়ারিখ (علم التواريخ) ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান
উক্ত বিষয়গুলোর জ্ঞান অর্জন করার পরই একজন মানুষ কুরআন নিয়ে কথা বলতে পারে বা লিখতে পারে। তাই আমরা যারা কুরআন নিয়ে কথা বলি বা লিখি আমাদের কেউই মুফাসসির নই। শুধুমাত্র কুরআন থেকে কুরআনের ব্যাখ্যা, কুরআন থেকে হাদীসের ও মনীষীগণের উপস্থাপিত তাবীলের সাহায্যে মানুষের সামনে কুরআনের বাণী ও শিক্ষা উপস্থাপনই লক্ষ্য। তাই গণমানুষের বুঝার জন্যই এ উপস্থাপনাকে তাফসীর হিসেবে পরিচিত করতে হচ্ছে। আর এই উপস্থাপনা ‘নুরুল ইরফান ফি তাফসীরিল কুরআন (نور العرفان فى تفسير القران) অর্থাৎ ‘আধ্যাত্মিকতার আলোকে আল কুরআনের তাফসীর’ নামে পেশ করছি।
“নুরুল ইরফান ফি তাফসীরিল কুরআন” এর অর্থ ‘আধ্যাত্মিকতার আলোকে আল কুরআনের তাফসীর’ ‘العرفانদ শব্দের মাঝে রয়েছে:-
‘ا’ (আলিফ) যার মধ্যে রয়েছে ‘الايمان’ অর্থ বিশ্বাস। ‘العرفان’ অর্থ পরিচায়ক। ‘ل’ এর মাঝে রয়েছে ‘لطف’ বা অনুগ্রহ। ‘لينت’ বা বিনয়। ‘ ر’ এর মাঝে রয়েছে ‘رحمت’ বা দয়া। ‘ف’ তে রয়েছে ‘فنا’ বা বিলীন হওয়া। আবার ‘ا’ যার মধ্যে রয়েছে ‘الانس’ বা আকর্ষণ ‘الاخوة’ বা ভ্রাতৃত্ব। ‘الالفة’ বা সৌহাদ্য। ‘ن’ এর মাঝে রয়েছে ‘النور’ বা আলো।
এক কথায় যে উপস্থাপনায় ঈমান, পরিচয় বা মারেফত, অনুগ্রহ, বিনয়, রহমতের দরিয়ায় বিলীন হওয়া, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্যর আকর্ষণে নূরের মহা সাগরে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে বাক্কা বা স্থাীয়ত্বের মাকামে পৌঁছা যাবে তার পথ নির্দেশনা ও গন্তব্যে পৌঁছার মহা সড়ক উন্মেচিত হবে তা-ই ‘আল ইরফান’। এ পথে গাইড লাইন হবে ‘القران’ তথা ‘ا’ এ  দৃঢ় বিশ্বাস। الاتصال বা মিলন। ‘ل’ তে ‘لينت’ তথা নম্রতা-বিনয়। ‘ق’ ক্বাফ দ্বারা ‘قربت’ বা নৈকট্য হাসিল করা। ‘ا’ আলিফ দ্বারা ‘الانس’ বা আকর্ষণ। আর ‘ق’ দ্বারা নূর বা আলো। এককথায় মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবীবের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের ভিত্তিতে বান্দার সাথে মাওলার মিলন ও কুরবত হাসিল করে সকল অন্ধকার, অনাচার, কুসংস্কার, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও কপট বিশ্বাস, কুফর, শেরেকে অন্ধকার দূরীভূত করার মাধ্যমে প্রিয় নবীর যাত-সিফাত ও তিনি যা নিয়ে এসেছেন সবটুকুর প্রতি একিন এনে নূরের জগতে নিজেকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে আল কুরআনকে মনে-প্রাণে আমলে, সংবিধানে ধারণ করা। এ লক্ষ্য নিয়ে আল কুরআনের কী আছে? এবং কুরআনে হাকীমের সাথে আমাদের জীবনের সম্পর্ক কি, আল কুরআনের আয়নায় ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র , ইহ ও পরকালীন জীবনে মুক্তির পথ নির্দেশনা কি কি, আমাদের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলোর উপস্থাপন হবে ‘নূরুল ইরফান ফি তাফসীরিল কুরআনের’ উদ্দেশ্য।
তাই শুরুতেই প্রিয় নবীজির উপর নূরের কুরআন, নূরের লৌহ মাহফুজ থেকে নূরের ফেরেশতা জিব্রাইলের মাধ্যমে, জাবালে নূরে, আপাদমস্তক নূরের খনি নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার নূরানী কালবে নাযিলকৃত প্রথম ওহী নিয়ে আমরা আলোকপাত করব। এরশাদ হচ্ছে-
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
“পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে”
১ : اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ [العلق- পড়–ন আপনার রবের (স্বত্বাধিকার বলে নিরংকুশ সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক) নামে বা আপনার রবকে চেনার জন্য যিনি সৃষ্টি করেছেন।
২ : خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ [العلق- সৃষ্টি করেছেন ইনসানকে জমাটবদ্ধ রক্ত থেকে।
৩ : اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ [العلق- পড়–ন আপনার রব মহিয়ান।
৪ : الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ [العلق - যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।
৫ : عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ [العلق- শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না।
এ পাঁচটি আয়াতে যে বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হয়েছে, তা হলো-
১। اقْرَأْ- পড়, (২) রবকে চেনার জন্য, রব অর্থ পালনকর্তা, বিধানদাতা, আইনদাতা।
২। خلق - বা সৃষ্টি, আল্লাহ خالق বা স্রষ্টা। তাঁর সৃষ্টিকে পড়তে হবে স্রষ্টাকে জানার জন্য।
৩। الْإِنْسَانَ- মানবসত্ত্বা, মানুষকে জানতে হবে।
৪। عَلَقٍ- জমাটবদ্ধ রক্তের পরিচয় উদঘাটন। অর্থাৎ দঅহধঃড়সরপ অহধষুংরং’ বা নৃ তাত্তিত্ব বিশ্লেষণে মানব সৃষ্টির রহস্য উদঘাটন।
৫। الْأَكْرَمُ- মহা সম্মানী, অতীব দয়ালু ও মেহেরবান রবের অবস্থা উপলব্ধি করতে হবে।
৬। عَلَّمَ- দ্বারা অন্যকে তা’লীম দেয়া।
৭। الْقَلَمِ- বা লেখনের মাধ্যমে কলমের ভূমিকা ও প্রয়োজনীয়তা।
৮। مَا لَمْ يَعْلَمْ- মানুষ যা জানেনা তা জানার পরিসর, পরিধির জ্ঞান। কি মানুষ জানেনা আর কি জানতে হবে সে রহস্য উদঘাটন।
এখন প্রশ্ন হল কি প্রেক্ষাপটে, কার কাছে কি উদ্দেশ্যে, কি পরিবেশে এ প্রথম ওহী নাযিল হল তা জানলে আল্লাহর কুরআন নামক জ্ঞান-বিজ্ঞানের মহা বিশ্বকোষ ও তত্ত্ব-তথ্যের মহাসাগরের অনন্ত সলিল ফল্গুধারা থেকে মুক্তো আহরণ করা সম্ভব হবে।
প্রক্ষোপট :
যে সময় আরব উপদ্বীপ ছিল জিহালাত তথা অন্ধকারে নিমজ্জিত, পবিত্র কাবায় স্থান পেয়েছিল ৩৬০ টি মূর্তি, লাত, মানাত, ওজ্জা, হোবল সহ বড় বড় মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। হত্যা-রাহাজানি-সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ-লুটতরাজ ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। বাবা হয়ে চাঁদের মত ফুটফুটে চেহারার মেয়েকে জীবন্ত কবর দিচ্ছে, একজন মহিলা সাত-আট জন পুরুষের ঘর করছে, পরিবারের সবাই সম্মিলিতভাবে মদের মাঝে বুঁদ হয়ে আছে, সুদ ছাড়া লেন-দেন নেই, গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ লেগে হাজার হাজার মানুষের রক্ত ঝরছে। শক্তির জোরে গরীব-দুঃখী-অসহায় মানুষের সম্পদ কুক্ষিগত করছে, রাজনৈতিক নেতৃত্বে চরম দূর্ণীতি, স্বজনপ্রীতি, গোত্রপ্রীতি চলছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোমান ও পারস্য স¤্রাটের বিশ্বব্যাপী জবর দখলের মহড়া চলছে। হীরা ও ইয়ামেনে চলছে চরম অরাজকতা। সমগ্র বিশ্ব যখন একজন ত্রাণকর্তার, একজন মুক্তিদাতার, একজন ফরিয়াদ শোনার মত নেতৃত্বের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। ঠিক সে সময় রহমত-বরকত হিসেবে আবির্ভূত হলেন ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’। শৈশব-কৈশর-যৌবনের ধাপে এ জাহেলী সমাজেও যিনি ‘الامين’ তথা একমাত্র বিশ্বাসী, সবচেয়ে সুন্দর যিনি, সবচেয়ে উত্তম চরিত্রের সমাহার যার মাঝে, সকলের মনের মানুষ, যার আপাদমস্তক নূরের খেলা চলছে, যিনি সমগ্র আরবে দানবীর, মেহমান নেওয়ায, সত্যবাদী, অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে আপোষহীন কণ্ঠস্বর। মজলুম মানবতার নাজাতের একমাত্র অবলম্বন, আমানত রক্ষায় নিজেই নিজের তুলনা, মেঘ যার মাথায় ছায়া দেয়, পশু-পাখী যাকে সম্মান জানায়, পাহাড়ের কালো কালো পাথরগুলো যাকে সালাম জানায়, সে মহান ব্যক্তিত্ব যখন সমগ্র জাতির, সমগ্র বিশ্বের অসহায় জনগোষ্ঠীর নাজাতের পথ খুঁজছেন। ধ্যানে-মুরাকাবায় কাটাচ্ছেন দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, জাবালে নূরের হেরা গুহায়। সে সময় নূরের ফেরেশতা, নূরের কুরআন নিয়ে জাবালে নূরে হাজির হলেন রেশমী কাপড়ে সোনালী অক্ষরে লেখা আল কুরআনের প্রথম পাঁচটি আয়াত নিয়ে। ডাক দিলেন নূরের নবীকে নূর গ্রহণ করার জন্য- اقرأ-  ‘পড়–ন’। তিনি কি পড়বেন, সৃষ্টিকে তো আগেই পড়েছেন। এখন পড়তে হবে ¯্রষ্টাকে। আর সৃষ্টির সাথে ¯্রষ্টার মিলনের ‘ডধু ড়ভ ৎবষধঃরড়হ’ মহা সড়কের গতিপথ কি আর কিভাবেই বা সেখানে পৌঁছা যায়। হেরা গুহায় মোরাকাবারত নূরের অস্তিত্বে ¯্রষ্টার নূরের জাল্ওয়া উদ্ভাসিত হওয়ার সাথে সাথে এ যেন নূরে নূরে প্রেম বিলানোর এক মহাকাল। যে আলোকপ্রভায় কালো পাথরের পাহাড়টি নূরের পাহাড়ে রূপান্তরিত হয়। মা আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার বর্ণনায় তাই তো এসেছে,
حتى جاءه الحق وهو في غار حراء فجاءه الملك (صحيح البخاري - ১ /৪ )
“হক এসেছে তিনি ছিলেন গারে হেরায় তারপর ফেরেশতা এসেছে।”
এ হক বা আল্লাহর নূরের জাল্ওয়া প্রকাশিত হওয়ার পর নূরের সাথে নূরের সংযোগ সাধনের পরই হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম এসে লৌহ মাহফুজের চ্যানেল ওপেন (ঙঢ়বহ) করে লিখিত কালাম তুলে ধরলেন। যার মাঝে রয়েছে ¯্রষ্টা, সৃষ্টি, সৃষ্টি রহস্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সৃষ্টির প্রতি ¯্রষ্টার দয়ার জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে কি শিখবে, কেন শিখবে, কিভাবে শিখবে, শিখে কি লাভ হবে এ সকল দিকের মহা দর্শণ, যা পৃথিবীর অন্যকোন ধর্মগ্রন্থে এভাবে উপস্থাপিত হয়নি। (চলবে)





بسم الله الرحمن الرحيم
দারসূল হাদীস: নিয়্যাতের শুদ্ধতা
মাও. মুহাম্মদ মামুনুর রশীদ আলক্বাদেরী আলআযহারী
মিশর আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় হাদীস বিভাগে ডিগ্রি প্রাপ্ত

عَنْ عُمَرَبْنِ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَقُوْلُ إِنَّمَا الْاَعْمَالُ بِالنِّيِّاتِ وَإِنَّمَا لِكُلِّ اِمْرِئٍ مَانَوَى فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ اِلَى اللهِ وَرَسُوْلِهِ فَهِجْرَتُهُ اِلى اللهِ وَرَسُوْلِهِ ، وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ لِدُنْيَا يُصِيْبُهَا أَوْ اَمْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا فَهِجْرَتُهُ اِلىَ مَا هَاجَرَ اِلَيْهِ ـ
অনুবাদ: হযরত আলকামা ইবনে ওয়াক্কাছ লাইছী বলেন: আমি উমর বিন খাত্তাব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কে মিম্বরের উপর বলতে শুনেছি যে, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে বলতে শুনেছি, নিশ্চয়ই যাবতীয় কর্মের ফলাফল নিয়্যাত অনুযায়ী হয়। আর নিশ্চয়ই প্রত্যেক ব্যক্তি যা নিয়্যাত করে তা-ই পায়। অতএব যার হিজরত হয়েছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে জন্য, তাঁর হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্যই হবে। আর যার হিজরত হবে দুনিয়া হাছিল করা কিংবা কোন নারীকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে, তাঁর হিজরত ঐ দিকে হয়েছে যে উদ্দেশ্য সে হিজরত করেছে।
হাদীসের বর্ণনাকারীর নাম ও বংশ পরিচিতি:
এ হাদীস শরীফ খানা বর্ণনা করেছেন ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা আমিরুল মুমিনিন হযরত উমর বিন খাত্তাব (রাদিয়াল্লাহু আনহু)
জন্ম: হযরত উসামা (রাদিয়ল্লাহু আনহু) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন: তিনি হযরত উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে শুনেছেন, নবী পাকের নবুওয়্যাত প্রকাশের ৩০ বছর পূর্বে হযরত উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) জন্ম গ্রহণ করেন। অন্য বর্ণনায় তিনি হস্তী বছরের (আবরাহার বাদশা যে বছর বিশাল হস্তী বাহিনী নিয়ে কা’বা ঘর আক্রমণ করেছিল) ১০ বছর পূর্বে জন্ম গ্রহণ করেন।
বংশ: হযরত উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন কুরাইশদের মধ্যে অধিক সম্মানিত ব্যক্তি। যখন কুরাইশদের সাথে অন্য কারো য্দ্ধু বাঁধত, তখন কুরাইশরা হযরত উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কে সকীর বা দূত হিসাবে প্রেরণ করত।
ইসলাম গ্রহণ: হযরত উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ইসলাম গ্রহণ করার পূর্বে মুসলমানদের উপর খুবই কঠিন ছিলেন। অত:পর তিনি ইসলামের ৬ষ্ঠ বৎসর নবী পাককে হত্যা করার নিমিত্তে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। যা ছিল নবী পাকের তাঁর প্রতি বিশেষ রহমত দোয়া।
ইসলামে তাঁর মর্যাদা: যাকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ওযীর বা সেনাপতি বলা হয়। যার দ্বারা আল্লাহ তায়ালা ইসলাম কে সাহায্য করেছেন। নবীপাকের পর যদি কোন নবী হত তবে উমর হত لو كان بعدى نبى لكان عمر الذى فر الشيطان منه যদি আমার পরে কোন নবী হত তবে উমর হত যার থেকে শয়তান পালাত। হযরত উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এর বক্তব্যের সাথে মিল রেখে অনেক কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল। তিনি ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা, ১০ বছর খেলাফতের দায়িত্ব থেকে ইসলামকে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার আসনে আসীন করেন।
হাদীস শরীফ বর্ণনা: হযরত উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) নবীপাক, হযরত আবু বকর ও উবাই বিন কা’ব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে হাদীস বর্ণনা করেন। তাঁর থেকে বর্ণনা করেন, তাঁর সন্তান হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর, আছেম এবং হযরত হাফসা (রাদিয়াল্লাহু আনহু), যিনি নবী পাকের স্ত্রীর মর্যাদা পেয়েছেন। তিনি উম্মাহাতুল মুমিনগণের একজন। তাঁর থেকে হযরত উসমান, আলী, সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস, তালহা, আব্দুর রহমান বিন আউফ রাযিয়াল্লাহু আনহুম) সহ আরো অনেকে হাদীস শরীফ বর্ণনা করেছেন।
তাবেয়ীগণের বর্ণনা: হযরত উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে হযরত সাঈদ বিন মুসাইয়্যাব, আলকামা ও আবু উসমান আন নাহদী রহমাতুল্লাহি আলাইহিম সহ অনেকে বর্ণনা করেন।
ইন্তেকাল: তাঁর ইন্তেকাল কোন দিন হয়েছিল, এ নিয়ে সাতটি মতামত রয়েছে। কিন্তু ইমাম যাহবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন- হযরত উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ৫৮ বা ৫৯ বছর বেঁচে ছিলেন। অত:পর তাকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সাথে দাফন করা হয়।
যে সমস্ত বিখ্যাত কিতাবে এ হাদীস খানা বর্ণিত:
১। বুখারী শরীফ, হযরত ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ হাদীস শরীফখানা তাঁর কিতাবে ৭ জায়গায় এনেছেন। কিতাবুল ওহী, কিতাবুন নিয়্যাত, কিতাবুল ইমান, কিতাবুল ইতক, কিতাবুল মানাকিবিল আনছার, কিতাবুল নিকাহ, কিতাবুল আইমান ও ওয়ান নুযুর, কিতাবুল হাইল।
২। মুসলিম শরীফে, হযরত ইমাম মুসলিম রহমাতুল্লাহি আলাইহি কিতাবুল ইমারাতে এ হাদীস শরীফ খানা বর্ণনা করেন।
৩। আবু দাউদ শরীফে হযরত ইমাম আবু দাউদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি কিতাবুত ত্বালাক এ।
৪) তিরমিজী শরীফ, কিতাবুল জিহাদে।
৫) ইমাম নাসায়ী, নাসায়ী শরীফ, কিতাবুত তাহারাত, কিতাবুল তালাক, কিতাবুল আহইমান ওয়ান নুযুর।
৬) ইবনে মাজাহ শরীফ, কিতাবুয যহুদ।
৭) মুসনাদে আহমদ, মুসনাদে উমর এ।
৮) ইমাম দারে কুতনি।
৯) ইমাম ইবনে হিব্বান সহী ইবনে হিব্বানে।
১০) ইমাম বায়হাকীসহ আরো অনেক।
হাদীসখানার হুকুম: অত্র হাদীসখানা “খবরে আহাদ” যা গরীব হাদীস। কারণ এটি হযরত উমর বিন খাত্তাবই নবীপাক থেকে বর্ণনা করেন। তবে এ হাদীস শরীফ খানা মাশহুর বর্ণনার দিক থেকে দুনিয়ার সকল ইমামগণ অত্র হাদীস শরীফটি সহীহ হিসেবে কবুল করেন এ জন্য তাদের কিতাব সমূহে ব্যাপকভাবে বর্নিত হয়েছে। তবে এটি মুতাওয়াতের পর্যায়ের নয়। হযরত ইমাম বদরুদ্দীন আইনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
هنا الحديث مع كثرة طرقه من الافراد ، وليس بمتواتر لفقدشرط التواتر
এ হাদীস শরীফটি একক দিক থেকে রেওয়াতের আধিক্যতা রয়েছে তবে তা মুতাওয়াতের নয়। মুতাওয়াতের হওয়ার শর্ত অনুপস্থিতির কারণে।
অত্র হাদীস শরীফের শরয়ী অবস্থান:
বর্ণনায় আছে- নিয়্যাতের হাদীস ইসলামের এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ইসলামের ৩ ভাগের ১ ভাগ।
হাদীসের ব্যাখ্যা: انما الاعمال بالنيات : إنما হাছরের জন্য ব্যবহৃত হয়, মূল হলো إِنَّ - ما একত্রিত করে إِنَّمَا । ইহা ইসমকে নসব বা যবর দেয় আর তার خبر কে পেশ দেয়। عمل এর বহুবচন اَعْمَال - نِيَّةٌ এর বহুবচন نِيَّاتٌ: النية) الارادة القصد العزم) ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, দৃঢ়, সংকল্প ইত্যাদি অর্থে আসে।
محله القلب : নিয়্যাতের অবস্থান ক্বলব। নিয়্যাত হলো অন্তরের ইচ্ছা। যথা: কোন কাজ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করা। উক্ত অংশ খানার অর্থ হবে إِنَّمَا كَمَالُ الاَعْمَالِ أَوْ ثَوَابُهَا بِالنِّيِّاتِ
হানাফী ইমামগণের মতে অর্থ হবে- সকল কর্মের পরিপূর্ণতা ও সাওয়াব সমূহ নিয়্যাত দ্বারা পরিúূর্ণ হয়ে থাকে। এ জন্য আমাদের মাজহাবে নামাজ ব্যতীত অন্য কোন ক্ষেত্রে নিয়্যাত ফরজ নয়। বরং নামাজে নিয়্যাত ফরজ। ওজু, গোসল এগুলোতে নিয়্যাত ফরজ নয়। এ জন্য হানাফী মাজহাবে কেউ যদি অন্যের পক্ষ হতে হজ্ব করার নিয়্যাত করে কিন্তু নিজে তার পূর্বে হজ্ব করেনি তবে তা নিয়্যাতি হজ্ব আদায় হবে।
হানাফি গণের মতামত: কেউ যদি ছরীহ বা স্পষ্ট তালাক্ব শব্দ উচ্চারণ করে আমি তোকে তালাক দিলাম, বা তুমি তালাক। নিয়্যাত না থাকলেও তালাক্বে রিজয়ী সংঘটিত হবে। আর যদি নিয়্যাত করে একের অধিক তবে ১টিই পতিত হবে।
নিয়্যাত সম্পর্কিত শিক্ষা:
* সকল কর্মের সাওয়াব ও পরিপূর্ণতা নির্ভর করে নিয়্যাতের উপর।
* নিয়্যাত অর্থ ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, সংকল্প ইত্যাদি।
ومنكم من يريد الدنيا ومنكم من يريد الاخرة : ال عمران: ১৫২
অর্থ: মানুষের মধ্যে কিছু আছে দুনিয়া চায় আর কিছু আছে আখেরাত চায়। এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য:
من كان يريد حرث الاخرة نزد له فى حرثه ومن كان يريد حرث الدنيا نؤته منها وماله ى الاخرة من نصيب (الشورى:২০)
অর্থ: যে আখেরারেত ফসল কামনা করে তার জন্য তা বাড়িয়ে দেই এবং যে দুনিয়ার ফসল কামনা করে আমি তাকে উহা হতে দেই আর আখেরাতে তার জন্য কিছুই থাকবে না। (শুরা:২০)
তবে দুনিয়া এবং আখেরাতে কল্যাণ একত্রে চাওয়া উত্তম। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন-
رَبَّنَا اتِنَا فِىْ الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِىْ الاخِرَةِ حَسَنَةً
ওগো আমাদের প্রতিপালক আপনি আমাদেরকে দুনিয়ায় এবং আখেরাতে কল্যাণ দান করুন। যারা দুনিয়া চাইতে গিয়ে আখেরাত ভুলে গিয়েছে তাদের জন্য আখেরাতে কিছুই থাকবেনা।
কিন্তু এখানে কোন নিয়্যত বা ইচ্ছা সর্বোত্তম এভাবে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
ذلك خير للذين يريدون وجه الله اولئك هم الفلحون (الروم:৩৮)
মূলত: যারা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি চায় তাদের জন্যই এটা উত্তম এবং তারাই সফল কাম। (সূরা রূম: ৩৮)
উপরোক্ত নিয়্যাতের অর্থ আলোচনা করতে গিয়ে আমরা মানুষের নিন্মেক্ত শ্রেণী পেলাম:
১)    এমন মানুষ যারা শুধু দুনিয়া চায়।
২)    এমন মানুষ যারা আখেরাতে ফসল চায়।
৩)    এমন মানুষ যারা দুনিয়া আখেরাত দুটিই চায়।
৪)    এমন মানুষ যারা শুধু মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি চায়।
সর্বশেষ যারা তারাই শ্রেষ্ঠ। কারন তারা কোন বিনিময় না চেয়ে শুধুই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি চায়। এরা হলো মুহসিন বা ওলি আল্লাহ। আর ২+৩নং হলেন মুমিন। ১নং এরা নাফরমান।
* প্রতিটি কর্মের পূর্বে উত্তম উদ্দেশ্য (نية صالحة) থাকা দরকার। হযরত ইমাম আব্দুর রহমান বিন মুহ্দি বলেন-
من اَرَادَ اَنْ يُّصَنِّفَ كِتَابًا فَلْيَبْدَاْ بِحَدِيْثِ الْاَعْمَالِ بِالنِّيَّاتِ
যে কোন কিতাব রচনা করতে ইচ্ছুক সে যেন انما الاعمال بالنيات দিয়ে শুরু করে।
* প্রতিটি কর্মে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টি চাওয়া বলা হয়েছে।
* حتى اللقمة এমনি একটি লুকমাতেও আল্লাহ-রাসূলের সন্তুষ্টি চাওয়া।
* هجرة অর্থ ত্যাগ করা, প্রস্থান করা, ছেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহ এবং তদীয় রাসূল صلى الله عليه وسلم যা নিষেধ করেছে তা পরিহার করাকে হিজরত বলা হয়।
এ হিজরত দু’ভাবে হতে পারে। ১. কোন ভয়-ভীতি পূর্ণ ভূখন্ড হতে হিজরত করে শান্তিপূর্ণ ভূখন্ডে চলে যাওয়া। যথা: ইসলামের প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহ صلى الله عليه وسلم এর নির্দেশ কি? সাহাবী মক্কা ছেড়ে হাবশায় হিজরত করেন। এরপর মক্কা হতে মদিনায় তিনি হিজরত করেন। ২. যে ভূখন্ডে কাফেরদের প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে, সে ভূখন্ডে অবস্থান করে ঈমান রক্ষা করা অসম্ভব হলে, মুমিনদের প্রভাবিত নিরাপদ ভূখন্ডে হিজরত করা।
উক্ত হাদীসে পাকে এ প্রকার হিজরতকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। যদি তা সকল খারাপ কাজ পরিত্যাগ করার অর্থে “আম” এ প্রকার হিজরত কিয়ামত পর্যন্ত চলবে।
খারাপ কাজ পরিত্যাগ করা সংক্রান্ত হাদীস শরীফ বর্ণিত হয়েছে- হুজুর আকরাম صلى الله عليه وسلم কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে- রাসূলুল্লাহ صلى الله عليه وسلم বলেছেন- মুহাজির হলো যে, আল্লাহ তায়ালা যা নিষেধ করেছেন তা পরিত্যাগ করে।
তাই মূলত আমাদেরকে প্রতিটি অবস্থায় আল্লাহ ও তার রাসূল صلى الله عليه وسلم যা নিষেধ করেছে তা থেকে বিরত থেকে মুহাজির হওয়ার তাওফীক দিন। আমীন।
হাদীস শরীফের প্রেক্ষাপট:
এ হাদীস শরীফটি মুহাজির উম্মে কায়েসের হাদীস নামে পরিচিত। ঘটনার সারকথা এই যে, উম্মে কায়েস নামী এক মহিলার নিকট এক ব্যক্তি বিবাহের প্রস্তাব দিলে সে ঐ ব্যক্তির মদিনায় হিজরত না করা পর্যন্ত তার সাথে বিবাহে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। উম্মে কায়েস হিজরত করে মদিনায় গমন করে। সেই ব্যক্তি নিরুপায় হয়ে উম্মে কায়েসকে বিবাহের উদ্দেশ্য মদিনায় হিজরত করে। এবং তাকে বিবাহ করে। তাই হাদীস শরীফে যে, দুনিয়া পাওয়া বা নারীকে বিবাহের উদ্দেশ্যে হিজরত করে তার হিজরত ঐ দিকে হবে। যদি ব্যহ্যত দেখা যায় লোকটিও হিজরত করেছেন কিন্তু নিয়্যাত ছিল ঐ নারীকে পাওয়া তাই প্রতিটি কর্মের সাওয়াব ও পূর্ণতা নিয়্যাতের উপর।
এ জন্যই ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন এ হাদীস শরীফটি ثلث العلم ইলমের এক তৃতীয়াংশ।

 
রজব মাসের ফজিলত ও বরকত
মাও. মুহাম্মদ ওসমান গণি আলক্বাদেরী


রজব মাসের ফজিলত ও বরকত:
এ প্রসংগে মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন-
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُوْرِ عِنْدَ اللهِ إِثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِىْ كِتَابِ اللهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّموتِ والْاَرْضَ مِنْهَا اَرْبَعَةٌ حُرُم (التوبة: ৩৬)
আল্লাহ তায়ালার কিতাবে (আল কোরআন) মাসের সংখ্যা ১২টি। যে দিন হতে আল্লাহ তায়ালা যমিন ও আসমানের সৃষ্টি করেছেন, সে দিন হতে চারটি মাস হারাম মাস। (তাওবা: ৩৬)
উক্ত আয়াতে চারটি হারাম মাস এর অর্থ হলো- এ চার মাসে কোন প্রকার য্দ্ধু-বিগ্রহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ চারটি মাসের সর্বপ্রথম মাস হলো পবিত্র রজব মাস, যিলক্বাদ, যিলহজ্জ, মুহররম।
মাসটির নামকরণ:
রজব মাসের নাম রজব কেন এ নিয়ে অনেক মতবেদ রয়েছে। মূলত: রজব শব্দটি تَرْجِيْبٌ (তারজীব) শব্দ হতে নির্গত। এর অর্থ কোন কিছু তৈরী করা, বা অগ্রসর হওয়া। এ প্রসংগে রাসূলে পাক ﷺ বলেছেন-
إِنَّهٗ لِيُرَجَّبُ فِيْهِ خَيْرٌ كَثِيْرٌ لشعبان
রজব মাসে শাবানের প্রভূত কল্যাণ প্রস্তুত বা তৈরী করা হয়।
রজব তিনটি হরফ। راء (রা) جِيْم (জিম) بَاءَ (বা) এর সমন্বয়ে গঠিত। এ তিনটি হরফ তিনটি নেয়ামতের প্রমাণ করে। (১) রহমত (২) দান (৩) নিরাপত্তা।
রজব মাসের অন্য কতগুলো নাম:
(১) رجب مُضر (রজবে মুদ্বার) রাসূলে খোদা ﷺ এ মাসটির নাম বলতে গিয়ে বলেছেন هُوَ رَجْبُ مُضَر الَّذِىْ بَيْنَ جَمَادى وشَعْباَنَ     রজব মুদ্বার হলো জমাদিউস সানি ও শাবানের মাঝা-মাঝি। (বুখারী শরীফ, ৬/৮৩পৃষ্ঠা, মুসলিম শরীফ আল কাসামা অধ্যায়ে, আহমদ ৫/৩৭ পৃ:, আবু দাউদ, বায়হাক্বী শরীফ।
অন্য একটি বর্ণনায় مُضَر একটি ক্বাবীলার নাম। যারা রজব মাসটিকে অনেক সম্মান করত বলে বলা হত- রজবে মুুদ্বার।
(২) شَهْرُ مطهر শাহরে মুতহার। (৩) শাহরে ছাবেক (৪) শাহরে আছাম شهر أصم (৫) শাহরে আছাব (৬) শাহরে ফারদ (৭) শাহরুল্লাহ।
رُوِىَ عَنْ عُثْمَانَ أَنَّه لَمَّا اِسْتَقْبَلَ رَجَبَ رَقَى الْمِنْبَرَ يَوْمَ الْجُمْعَةِ وَخَطَبَ ثُمَّ قَالَ : اَلاَ اِنَّ هَذَا شَهْر اللهِ الْاَصَمِّ وَهُوَ شَهْرُ بَرَكَاتِكُمْ فَمَنْ كَانَ عَلَيْهِ دَيْنٌ فَلْيُوَدِّ دَيْنَهُ ثُمَّ لِيُزَكِّ مَا بَقِىَ
    হযরত উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রজব মাসটি যখন আগমন করে তখন তিনি শুক্রবার দিন মিম্বরে আরোহন করে তিনি ভাষণ প্রদান করেন। অতপর বলেন, হে মুসলমানগণ তোমরা জেনে রাখ। এ মাসটি আল্লাহর বদীর মাস। আর এ মাসটি হলো তোমাদের যাকাত আদায়ের মাস। অত:পর যে ঋণ গ্রস্থ সে এই পবিত্র মাসে ঋন আদায় করে দিবে অত:পর তাঁর কাছে যা রয়েছে তা অবশ্যই পবিত্র করে নিবে।
قِيْلَ سُمِّىَ اَصَمُّ لِاَنَّهُ لَمْ يَنْزِلْ فِيْهِ غَضَبُ اللهِ تَعَالى عَلى قَوْمٍ لِاَنَّ اللهَ تَعَالى عَذَّبَ الْاُمَمَ الْمَاضِيَةِ فِىْ سَائِرِ الشُّهُوْرِ وَلَمْ يُعَذِّبْ اُمَّةً مِنْ الْاُمَمِ فِىْ هَذَا الشَّهْرِ ـ
বলা হয়েছে যে, আছামা বা (বদীর) নামে এ মাসটির নাম করণের কারণ হলো। এ রজব মাসে কোন জাতির উপর আল্লাহর তায়ালার গজব নাযিল হয়না। অন্যান্য উম্মাতের উপর এ রজব মাস ব্যতীত সকল মাসে আজাব অবতীর্ণ হত।
রোজার ফজিলত:
হযরত আবু সাঈদ আল খুদুরী (রাদিয়াল্লাহ আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ হতে বর্ণনা করেন- হে মুসলমানগণ তোমরা জেনে রাখিও নিশ্চয়ই রজব আল্লাহ তায়ালার মাস, শা’বান আমার মাস এবং রমাদ্বান আমার উম্মতের মাস। অত:পর জেনে রাখ! রজব মাস আল্লাহ তায়ালার হারাম (যে মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ নিষিদ্ধ) মাসের অন্যতম মাস।
রজব মাসে কেউ যদি ঈমান অবস্থায় ছাওয়াবের নিয়্যাতে ১টি রোজা রাখে, তবে সে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করে। যদি দুটি রোজা রাখে, তবে সে দ্বিগুণ নেকী লাভ করে। উহার প্রতিটি নেকীর ওজন দুনিয়ার এক একটি পর্বত তুল্য। যে ব্যক্তি এ মাসে তিনটি রোজা রাখে, আল্লাহ সে ব্যক্তি ও দোজখের মধ্যে একটি পরিখা খনন করে দেন। যে পরিখাটির দৈর্ঘ্য এক বছরের পথের সমান। যে ব্যক্তি এ মাসে চারটি রোজা রাখে, সে দুনিয়ার যাবতীয় সকল বিপদাপদ হতে মুক্ত থাকে। যে ব্যক্তি পাঁচটি রোজা রাখে সে কবর আযাব হতে মুক্ত থাকবে। যে ছয়টি রোজা রাখে, সে রোজ কিয়ামতে চন্দ্রের ন্যায় উজ্জল মুখমন্ডল বিশিষ্ট উঠিবে। সে সাতটি রোজা রাখবে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর জন্য সাতটি জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি ৮টি রোজ রাখবে তাঁর জন্য বেহেশতের আটটি দরজাই খুলে দেন। যে ব্যক্তি এ মাসে নয়টি রোযা রাখে, সে কবর হতে উঠতে আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু কালেমা পাঠ করতে করতে উঠবে। আর যে ব্যক্তি রজব মাসে দশটি রোযা রাখে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য দোজখের পুল পার হবার জন্য প্রত্যেক ক্রোশে একটি করে বিছানা বিছিয়ে দিবেন। উক্ত ব্যক্তি এ বিছানা শুয়ে শুয়ে আরামের সহিত জাহান্নাম পার হবে। (এভাবে আরো হাদীস শরীফ রয়েছে.............)
মোট কথা হলো হুজুর গাউছুম আজম (রাদিয়াল্লাহু আনহু) রজব মাসের রোজার অসংখ্য ফজিলত বর্ণনা করেছেন তাঁর লিখিত কিতাব “গুনিয়াতুল তালিবীন” এর মধ্যে।

রজবর ১ম দিন ও রাতের ফজিলত:
وَعَنْ اَنَس بن مَالِكٍ  مَنْ صَامَ اَوَّلَ يَوْمِ مِنْ رَجَبٍ كَفَّرَ اللهُ ذُنُوْبَ سَنَتَيْنِ وَمَنْ صَامَ خَمْسَةَ عَشَرَ يَوْمًا حَاسَبَهُ اللهُ حِسَابًا يَسِيْرًا وَمَنْ صَامَ ثَلاَثِيْنَ يَوْمًا مِنْ رَجَبٍ كَتَبَ اللهُ لَهُ رِضْوَانَهُ وَلَمْ يُعَذِّبْهُ ـ
হযরত আনাস বিন মালেক (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, যে ব্যক্তি রজবের ১ম দিন রোজা রাখবে মহান আল্লাহ তার দু’বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি ১৫ দিন রোজা রাখবে মহান আল্লাহ তাঁর হিসাব সহজ করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি ৩০ দিন রোজা রাখে তাঁর জন্য মহান আল্লাহ তাঁর সন্তুষ্ট লিখে দিবেন আর তাকে আজাব দেয়া হবে না। (গুনিয়াতুল তালেবীন ১ম খন্ড, পৃ: ৩২৭, মূল কিতাব দেখুন)
রজব মাসের দোয়া সমূহ:
عَنْ اَنَسِ بْنِ مَالِكٍ  قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ اِذَا دَخَلَ رَجَبُ قَالَ اَللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِىْ رَجَبِ وَشَعْبَانَ وَبَلِّغْنَا رَمَضَانَ كَمَا بَلَّغْتَنَا رَجَبَ ـ احمد ১/২৫৯ والدر المنثور ১/১৮২
হযরত আনাস বিন মালেক (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন রজবের ১ম দিন শুরু হত তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলতেন- আল্লাহুম্মা বারেক লানা ফি রাজাবি ওয়া শা’বানা ওয়া বাল্লিগনা রমাদ্বানা কামা বাল্লাগতানা রাজাবা।
হে আল্লাহ তায়ালা রজব ও শা’বান মাসে আমাদেরকে পরিপূর্ণ রবকতময় করুন এবং আমাদেরকে রমদ্বান মাসে পৌঁছে দিন যেমন রজব মাসে আমাদেরকে পৌঁছিয়েছেন।”
রজব মাসের ইবাদত:
দিনের বেলা রোজা রাখা আর রাতে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে কিয়ামুল লাইল বা রাত্রি জাগরণ করার বিধান রয়েছে-
عن سلمان  عن النَّبِىِّ ﷺ اَنَّهُ قَالَ وَقَدْ اِسْتَهَلَّ رَجَبُ يَا سَلْمَان مَا مِنْ مُؤْمِنٍ وَلاَ مُؤْمِنَةٍ يُصَلِّى فِىْ هَذَا الشَّهْرِ ثَلاَثِيْنَ رَكْعَةً يَقْرَءُ فِىْ كُلِّ رَكْعَةٍ فَاتِحَةِ الْكِتَابِ (وقُلْ هُوَ اللهُ اَحَد....) ثَلاَث مَرَّات وَقُلْ يَا اَيُّهَا الْكَافِرُوْنَ ثَلاَث مَرَّات إِلاَّ مَحَا اللهُ عَنْهُ ذُنُوْبَهُ وَاَعْطَى مِنَ الْاَجْرِ كَمَنْ صَامَ الشَّهْرَ كُلَّهُ وَكَانَ مِنَ الْمُصَلِّيْنَ اِلَى السَّنَةِ الْمُقْبِلَةِ ، وَرَفَعَ لَهُ كُلَّ يَوْمٍ عَمِلَ شَهِيْدٍمِنْ شُهَدَاءِ بَدْر ، وَكَتَبَ لَهُ بِصِيَامِ كُلَّ يَوْمٍ عِبَادَةَ سَنَةٍ ، وَرَفَعَ لَهُ اَلْفَ دَرْجَةٍ ، فَاِنْ صَامَ الشَّهْرَ كُلَّهُ وَصَلَّى هَذِهِ الصَّلاَةَ اَنْجَاهُ اللهُ مِنَ النَّارِ وَاَوْجَبَ لَهُ الْجَنَّةَ ، وَكَانَ فِىْ جِوَرِ سُبْحَانَهُ ، وَاَخْبَرَنِىْ بِذَالِكَ جِبْرِيْلُ عَلَيْهِ السَّلاَمِ وَقَالَ ! يَا مُحَمَّدُ هَذِهِ عَلاَمَةٌ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَ الْمُشْرِكِيْنَ وَالْمُنَافِقِيْنَ لِاَنَّ الْمُنَافِقِيْنَ لاَيُصَلُّوْنَ ذَلِكَ ـ
হযরত সালমান ফরাসী (রাদিয়াল্লাহু আন্হু) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন। নিশ্চয়ই তিনি বলেন: অবশ্যই রজব মাস আগমন করেছে: ওহে সালমান! যদি কোন মুমিন পুরুষ বা রমণী রজব মাসে ত্রিশ রাকাত নামাজ প্রত্যেক রাকাতের সূরা ফাতেহার পর (কুল হুয়াল্লাহু আহাদ.....) এ সূরা তিনবার আর (কুল ইয়া আইয়্যুহাল কাফিরুন.....) তিনবার পাঠ করবে তবে আল্লাহ তায়ালা তার সকল গুনাহ মার্জনা করে দেন এবং সমস্ত মাস রোজা রাখার মত পূণ্য দান করেন। আগামি বৎসরের আগাম নামাজীদের দলে তাকে অন্তর্ভূক্ত করেন। আর তার জন্য প্রত্যেক দিনে বদরে শহীদগণের হতে একজন শহীদের আমাল লিখে দেন। প্রত্যেক দিনের রোজার বিনিময়ে এক বৎসরের সওয়াব লিখে দেন। আর তার মরতবা হাজারে উন্নীত করেন আর যদি কেহ এ মাস পূর্ণ মাসে রোজা রাখে তবে তাকে মহান আল্লাহ জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। এবং তার জন্য জান্নাত আবশ্যক করেন সে মহান আল্লাহর রমহতের মধ্যে থাকবে। হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: জিব্রাইল আলাইহিস সালাম আমাকে এ বিষয়ে সংবাদ দিয়েছেন। এবং তিনি বলেন, ওহে মুহাম্মাদ! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ আলামত আপনাদের মাঝে আর মুশরিক ও মুনাফিকদের মাঝে। কেননা মুনাফিকরা এ নামাজ আদায় করে না।
فصل: فى الصلاة الواردة فى شهر رجب ص:৩২৯ جلد: ১
হযরত সালমান ফারসী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) আরজ করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! রজব মাসের উক্ত নামাজ কখন আদায় করবো? তিনি বলেন: হে সালমান মাসের প্রথমে। আর নামাজের সালাম ফিরানোর পর হাত তুলে এ দো’আ বলবে-
لاَ اِلهَ اِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ يُحْيِىْ وَيُمِيْتُ وَهُوَ حَىٌّ لاَيَمُوْتُ ، بِيَدِهِ الْخَيْرُ وَهُوَ عَلىَ كُلِّ شَيْئٍ قَدِيْرٌ ، اَللَّهُمَّ لاَ مَانِعَ لِمَا اَعْطَيْتَ وَلاَ مُعْطِىَ لِمَا مَنَعْتَ وَلاَيَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الْجَدُّ ـ
উচ্চারণ: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু অহদাহু লা শারীকা লাহু লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ইউহয়ী ওয়া ইউমীতু ওয়া হুয়া হায়্যুল্লা ইয়ামুতু বিয়াদিহিল খাইরু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর। আল্লাহুম্মা লা-মানেয়া লিমা আতাইতা ওয়ালা মু’তিয়া লিমা মান’তা ওয়া ইয়ানফাউ যাল যাদ্দি মিনকাল জাদ্দু।
সালাতুল খাইর:
সালাতুল খাইর ১০০ রাকাত নামায ২৬ তারিখ দিবাগত রাত্রিতে ১০০ রাকাত সালাতুল খায়ের নামাজ ১,০০০ (কুল হুয়াল্লাহু আহাদ), প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতেহা ১ বার, কুল হুয়াল্লাহু আহাদ ১০ বার।
হযরত গাউছুল আ’জম (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর “গুনিয়াতুত ত্বালেবীন” কিতাব ৩২৮ পৃ: মধ্যে বছরে ১৪ রাত্রিতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করার মুস্তাহাব উক্ত রাত্রি সমূহের মধ্যে রজবের প্রথম রজনী রয়েছে।
(পরবর্তী সংখ্যায় দিন সমূহ বর্ণনা করা হবে)
বি:দ্র: যদি কেহ ইচ্ছা করে ১ বার কুলহুয়াল্লাহু আহাদ কম বা বাদ দেয় তবে সালাতুল খায়ের নামাজ হবে না। নফল হিসেবে আদায় হবে।

 
“দীদারে ইলাহীতে নূরুন্নাবী সারওয়ারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম”
মাওলানা কাজী মোস্তাফিজুর রহমান বাশারী 


কবির ভাষায়-
আরশে আ’লায় গেলে মি’রাজ রাতে
মধুর মিলন হল খোদার সাথে।।
পেয়ে চরণধূলা পাক ক্বদমের
ধন্য আরশে মক্বাম।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:
سبحن الذى اسرى بعبده ليلامن المسجد الحرام الي المسجد الاقصى الذي بركنا حوله لنريه من اياتنا انه هو السميع البصير.
“অতি পবিত্র তিনি যিনি রাতের কিয়দংশ স্বীয় বান্দাকে (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছেন। যাহার চতুষ্পার্শ আমি বরকতপূর্ণ করেছি এজন্য যে, তাকে আমি স্বীয় নির্দশনাবলী দেখাব। নিশ্চই তিনি সব কিছু দেখেন, সবকিছু জানেন।
উপরোক্ত আয়াতে কারীমার দ্বারাই আল্লাহর হাবীবের স্বশরীরে মি’রাজ প্রমাণিত। যারকানী (র.) বলেন নবীজির পয়তাল্লিশ জন সাহাবীর রেওয়ায়েত দ্বারা মি’রাজ প্রমাণিত। এছাড়া পবিত্র কুরআনের সূরা আন-নাজমের ১-১৮ নং আয়াত এবং সূরা তাকবীরের ১৯-২৪ নং আয়াতে পবিত্র মি’রাজ শরীফের ব্যাপারে বিস্তারিত প্রমাণ পাওয়া যায়। পবিত্র কুরআন এবং হাদীসের আলোকে মি’রাজ শরীফের প্রেক্ষপটসহ আলোচনা তুলে ধরতে চেষ্ঠা করব ইনশাআল্লাহু তায়ালা।
পবিত্র কুরআনুল কারীমের সূরা বনী ইস্রাঈলের যে আয়াতটি দ্বারা পবিত্র মি’রাজ শরীফ প্রমাণিত। সেখানে মহান রাব্বুল আলামীন এটি ইস্রা (اسراء) শব্দ দ্বারা প্রকাশ করেছেন। যা কালাম শাস্ত্রীয় কিতাবে এটিকে মি’রাজ বলা হয়েছে। সুতরাং মি’রাজ শরীফের বিশদ আলোচনার জন্য ইস্রা (اسراء) এবং মি’রাজ (معراج) এতদুভয়ের পৃথক আলোচনা প্রয়োজন।
ইস্রা (اسراء) শব্দের অর্থ রাতের ভ্রমণ, নৈশ ভ্রমণ।  যেহেতু নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ ভ্রমণ রাতে করানো হয়েছিল সেহেতু পবিত্র কুরআনে এটিকে اسراء বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই বলে ইস্রা মি’রাজের প্রতিবন্ধক নয়।
মি’রাজ (معراج) শব্দটি উরূজ (عرج) ক্রিয়ামূল থেকে নিষ্পন্ন। এর অর্থ উর্ধ্বগমন বা উর্ধ্বে আরোহন করা।  যেহেতু হাদীসে নববীতে “উরিজা বী” (عرج بي) অর্থাৎ আমাকে উর্ধ্ব জগতে আরোহন করানো হয়েছে। তাই হাদীসের ভাষায় এটিকে মি’রাজ (معراج) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ইসলামী বিশ্বকোষে এসেছে মি’রাজ (معراج) শব্দটি عرج ক্রিয়ামূল হতে ইসমে আলা (اسم اله) এর সীগাহ্। বাংলায় এটি করণবাচ্য বাচক বিশেষ্য পদ। عرج، يعرج-عروجا- ومعرجا অর্থ হলো সিড়ি বেয়ে উপরে উঠা, সিড়ি, সোপান। ইসলামি পরিভাষায় এর অর্থ হলো উচ্চ মর্যাদা, আধ্যাত্মিক পূর্ণতা। বিশেষত আল্লাহর নৈকট্য লাভ।
পারিভাষিক অর্থে মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণকে ইস্রা এবং মসজিদে আকসা হতে আরশে আযীম পর্যন্ত ভ্রমনকে মি’রাজ বলে।  সুতরাং বুঝা গেল যে, মি’রাজ শব্দটি ইস্রা এবং মি’রাজ উভয়কে সামিল করে। কিন্তু ইস্রা উভয়টিকে সামিল করে না।
সময়কাল:
পবিত্র মি’রাজ শরীফের সময়কাল নিয়ে ওলামায়ে কিরামদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে।
ক্স    সহীহ আল বুখারীতে এসেছে পবিত্র মি’রাজ শরীফ আকাবার বাইয়াত সমূহের পূর্বে হয়েছিল।
ক্স    ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক বলেন মিরাজের ঘটনাটি আবু তালিব ও উম্মুল মু’মেনীন হযরত খাদিজা (রা.) এর ইন্তিকালের পূর্বের ঘটনা।
ক্স    ইবনুল আসীরের মতে মি’রাজ হিজরতের তিন বছর পূর্বের ঘটনা।
ক্স    প্রসিদ্ধ অভিমত অনুসারে রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল।
আল্লাহর সৃষ্টির অনুপম নিদর্শন প্রত্যক্ষকরণ:
পবিত্র হাদীসে নববী ও ইতিহাসের গ্রন্থ সমূহ থেকে জানা যায় যে, একদা দয়াল নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মে হানী বিনতে আবু তালিব (রা.) এর ঘরে শায়িত অবস্থায় ছিলেন। তন্দ্রাভিভূত অবস্থায় হঠাৎ দেখতে পেলেন যে, ঘরের ছাদ উন্মুক্ত হয়ে গেছে, আর এই উন্মুক্ত স্থান দিয়ে মুয়াল্লিমুল মালাইকা হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস্ সালাম কয়েকজন ফেরেস্তা নিয়ে অবতরণ করলেন। হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস্ সালাম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মসজিদুল হারামে নিয়ে গেলেন। সেখানে পৌছে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হযরত জিব্রাঈল ও মীকাঈল আলাইহিস্ সালাম এসে নবীজিকে বিশ্রাম শেষে যমযম কূপের কাছে নিয়ে যান। অতপর নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে শোয়াইয়া ছিনা চাক (বক্ষ বিদারণ) করেন এবং তাহার কলবকে যমযম পানি দ্বারা ধৌত করেন। তার পর গর্দভ হতে বড় এবং খচ্ছর হতে ছোট সাধা রং বিশিষ্ট লম্বা আকৃতির বুরাক নামের ঐশী বাহন আনা হল। বুরাকের এক ক্বদম মানুষের দৃষ্টি সীমানাকে অতিক্রম করত। নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বুরাকে আরোহন করতেই বুরাক খুশীতে আত্মহারা হয়ে নাচতে আরম্ভ করল। হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস্ সালাম বললেন হে বুরাক তুমি এটা কী ধরনের আচরণ করতেছ অথচ তোমার মাঝে এই জগত সমূহের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি আরোহন করেছেন। তখন বুরাক লজ্জিত হয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে রওয়ানা করল। তখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গী ছিলেন হযরত জিব্রাঈল ও মীকাঈল আলাইহিস্ সালাম। তাইতো শায়খুল র্কোরা মুজাদ্দিদে জামান ফখরে, মিল্লাত হযরত শাহ আবদুস সোবহান আল ক্বাদেরী (রা.) তার প্রণীত “কাসিদায়ে সোবহান” এর মধ্যে বলেন-
জিবরীলে বোলেকে মুস্তাফা তোঝহে খোদা নে তলব কিয়া
ভেজা বুরাক কো আওর কাহা মেরে পিয়া কো শেতাবালা।
আরশে বাঁরি ফলক মেযা চাড়ছে নবী বিকামালিহী
সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি
“জিব্রাঈল আলাইহিস্ সালাম মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলেন আপনাকে খোদা ডেকে পাঠিয়েছেন
বোরাক পাঠিয়ে দিয়ে বলেন যে দ্রুত আমার প্রেমিককে নিয়ে আস।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় চরমোৎকর্ষ সহকারে আকাশ সমূহে গিয়ে আরশে আজিমে
তারই শানে ও তার পরিবার বর্গের প্রতি তোমরা দরুদ শরীফ পড়।
এই বুরাক নামক বাহনে চড়ে বিশ্বকুল সরদার হুজুর নবীয়ে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌছে সকল নবীদের ইমামতি করে দু’রাকাত নামায আদায় করেন। এজন্য নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে ইমামুল আম্বিয়া (সকল নবী-রাসূলগণের ইমাম) বলা হয়। তারপর তিনি বুরাকে চড়ে উর্ধ্বে আরোহন করতে থাকেন। একের পর এক আসমান অতিক্রম করতে থাকেন। সেখানে প্রতিটি আসমানে অবস্থানরত প্রধান প্রধান ফেরেস্তা এবং উলূল আযম আম্বিয়ায়ে কেরামগণ হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাক্ষাত লাভে ধন্য হন। প্রথম আসমানে হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম,দ্বিতীয় আসমানে হযরত ঈসা ইবনে মারইয়াম ও ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া, তৃতীয় আসমানে ইউনূস ইবনে ইয়াকূব, চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রীস, পঞ্চম আসমানে হযরত হারূন ইবনে ইমরান, ষষ্ঠ আসমান হযরত মূসা ইবনে ইমরান সর্বশেষ সপ্তম আসমানে মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালাম নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাক্ষাত লাভ করেন এবং সালাম বিনিময় করেন।
অতপর নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নিয়ে বুরাক বাইতুল মা’মুরে উপস্থিত হয়। সেখানে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফেরেস্তাদেরকে নিয়ে দু’রাকাত নামায আদায় করেন তারপর বুরাক নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নিয়ে “সিদ্রাতুল মুন্তাহা” নামক স্থানে পৌছে দেন। হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস্ সালাম উপরে যাওয়ার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করেন।
পরবর্তীতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্য আরেক ঐশী বাহন রফরফ (সুসজ্জিত সিংহাসন) উপস্থিত করা হয়। এটি সত্তর হাজার নূরের পর্দা অতিক্রম করে নূর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বহন করে বিশ্বস্রষ্টা মহান আল্লাহর দরবারে হাজির করে দেয়। নূর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান প্রভূর সানিধ্যে ও একান্ত নৈকট্যে এমনকি দুই ধনুক অপেক্ষা নিকটে মিলিত হন।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন
ثم دنا فتدلي فكان قاب قوسين او ادنى ــ
“অত:পর তিনি কাছাকাছি আসলেন, আরো নিকটে আসলেন। এমনকি দুই ধনুক পরিমান দূরত্ব রইল বরং তার চেয়ে কম। অর্থাৎ দুই ধনুক অপেক্ষা আরো কাছাকাছি আসলেন।”
হিজরী চতুর্থ শতকের মুজাদ্দিদ কাযী আয়ায (রা.) বলেন-
وقال ابن عباس (رضـ) هو اى قوله تعالى دنى فتدلى مقدم و مؤخر فاصله فتدلى فدنا اى فتدلى الرفرف لمحمد صلى الله تعالى عليه وسلم ليلة المعراج فجلس عليه ثم رفع ودنا من ربه ــ
“হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন- নৈকট্য ও সৌহার্দ্যের মধ্যে অগ্র পশ্চাৎ হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে এরূপ যে, প্রথমে সৌহার্দ্য ও পরে নৈকট্য। এর অর্থ হলো হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাহন হিসেবে মি’রাজের রাতে একটি রফরফ  অবতীর্ণ হয়। তিনি এতে আরোহন করেন অত:পর তাকে উত্তোলন করা হয়। এমনকি তিনি স্বীয় প্রতিপালকের একান্ত নৈকট্যে পৌছে যান।
    এই ভ্রমনে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন কাফেলার সাথে সাক্ষাত, উল্লেখযোগ্য স্থানের যিয়ারত, আল্লাহর সৃষ্টির অপরিমেয় ও উপমাহীন নিদর্শন, নানা শ্রেণীর ব্যক্তিদের উপর খোদায়ী আযাব, আসমানে আরোহন, আলমে মালাকুতে ভ্রমন, বিভিন্ন আম্বিয়ায়ে কিরামের সাথে সাক্ষাত, জান্নাত জাহান্নাম পরিদর্শন, সিদ্রাতুল মুন্তাহা ইত্যাদি প্রত্যক্ষ করেন। মহান আল্লাহ বলেন -
عند سدرة المنتهى عندهاجنة الماوىـ
“সিদ্রাতুল মুন্তাহার নিকটে (বৃক্ষ বিশেষ) উহার নিকটেই জান্নাতুল মাওয়া রয়েছে।”
এজন্য নবীজিকে সকল কিছুর প্রত্যক্ষ কারী বলা হয়। পবিত্র কুরআনে এসেছে
 انا ارسلنك شاهدًا ومبـشــرًا ونزيـرًاـ
“নিশ্চই আমি আপনাকে সাক্ষ্য প্রদানকারী, সুসংবাদদাতা এবং ভয় প্রদর্শন কারী হিসেবে প্রেরণ করেছি।”
স্বশরীরে মিরাজের প্রমাণ:
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা হলো নূর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বশরীরে মি’রাজ করেছেন। যদিও আলেমদের মধ্যে একটি সম্প্রদায় বলেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু আত্মিকভাবে মি’রাজ করেছেন। সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য অভিমত হলো মি’রাজ স্বশরীরে সম্পন্ন হয়েছে।
এক: যদি স্বপ্নে বা আত্মিক ভাবে মি’রাজ হত তাহলে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে আস্রা বি আব্দিহী (اسرى بعبده) বলতেন না বরং তার পরিবর্তে আস্রা বিরুহিহী (اسرى بروحه) অথবা আস্রা ফি মানামিহী (اسرى فى منامه) বলতেন। কেননা আবদ (عبد) বলতে রুহ (روح) এবং জাসাদ (جسد) উভয়কে বুঝায়। এটির একটি শূণ্য হলে ব্যক্তির মধ্যে আব্দ এর বৈশিষ্ট্য থাকে না।
দুই: ইস্রা বা মি’রাজ শুধুই আত্মিক হলে তা নবুওয়তের প্রমাণ হিসেবে অর্থাৎ মু’জিযা হিসেবে পরিগণিত হত না।
তিন: তাছাড়া পবিত্র কুরআনে সরাসরি নস (প্রমাণ) রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন- ثم دنا فتدلي فكان قاب قوسين او ادنى অর্থাৎ অত:পর তিনি কাছে আসলেন আরও কাছে এমনকি দুই ধনুক অপেক্ষা অথবা তারচেয়ে কম দূরত্বে আসলেন।
নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহকে দেখেছেন কিনা: মি’রাজ রজনীতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহ তাবারুকু তায়ালাকে দেখেছেন কিনা এটি একটি বির্তকিত বিষয়। উল্লেখ্য আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা হলো নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহকে তার স্বীয় চক্ষু মোবারক দ্বারা দেখেছেন।
হাদীসে নববীতে বর্ণিত আছে যে, সয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে যখন জিজ্ঞেস করা হলো আপনি কি আল্লাহ তায়ালাকে দেখেছেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নূরানী জবানে উত্তর দিলেন হ্যাঁ আমি মি’রাজে আমার প্রভূকে দেখেছি। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন-
رايت ربى فى احسن صورةـ
“আমি আমার রবকে অতি উত্তমভাবে দেখেছি।”
মুসনাদে আহমদে সহীহ সূত্রে বর্ণিত আছে-
عـن ابن عباس (رضـ) قال قال رسول الله صلى الله تعالى عليه وســلـم رايـت ربـى عز وجل ــ
“হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, আমি আমার সর্বশক্তিমান প্রভূকে দেখেছি।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে আল্লাহ তায়ালার তোহ্ফা: বন্ধু বন্ধুর বাড়িতে গেলে তাকে আপ্যায়নের পাশাপাশি বন্ধুকে হাদিয়া তোহ্ফা দেয়া আল্লাহর সুন্নাত। হুজুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে ও আল্লাহ তায়ালা পবিত্র মি’রাজ শরীফে হাদিয়া তোহফা দিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ তায়ালা তার বন্ধুকে এভাবে অভিবাদন জানিয়েছেন। আল্লাহ বলেন-
الــســلام عليك ايها النبى ورحمة الله وبـركاته ـ
“ হে নবী! আপনার প্রতি সালাম এবং আল্লাহর রহমত ও তার বরকত রাজি নাযিল হউক।”
তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই শান্তির বাণীকে শুধু নিজের জন্য গ্রহণ করেননি বরং তার স্বীয় নেক উম্মতদেরকে ও সামিল করেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে আল্লাহর অভিবাদন গ্রহণ করেন-
الــســلام علينا وعلى عباد الله الصالحين ـ
“আমাদের প্রতি এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।”
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উম্মতের জন্য এক অশেষ হাদিয়া মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাতকে কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত নিয়ে আসেন। নবী করীম (সা:) বলেছেন-
“তোমাদের মধ্যে যে কেউ ঈমানের সাথে, ছাওয়াবের আশায় পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করবে সে পূর্ণ পঞ্চাশ ওয়াক্তের সাওয়াব পাবে।” নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর দীদারে ধন্য হয়েছেন সাথে সাথে তার উম্মতের জন্য ও আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-

الصلرة معراج المؤمينـن ـ
অর্থাৎ : “সালাত মুমিনের জন্য মি’রাজ তথা আল্লাহর দীদার স্বরূপ” তাই মুসলিম উম্মাহর জন্য মি’রাজের অন্যতম শিক্ষা হল সর্বাবস্থায় নামাযকে মনে প্রাণে লালন করা এবং সমাজে নামায কায়েম করা। তাহলেই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মি’রাজ রজনীতে আনীত হাদিয়ার সঠিক মূল্যায়ন হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।
আল্লামা শেখ সাদী (রা.) বলেন-
“একরাতে চড়েছিলেন বুরাকের পিঠে
সপ্ত আকাশ ছেড়ে গেলেন উপরেতে উঠে”
মর্যাদা ও সম্মান বেড়ে গেল তার
কুলাইতে না পারিল ফেরেস্তা আল্লাহর”১৬

  কাব্যিক ভাষান্তর, মূল শেখ সাদী (র.) বোস্তা, পৃ. ২৩-২৪।


 
পবিত্র মে’রাজুন্নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং নামাজ প্রসঙ্গ
আলহাজ্ব মাওলানা ইয়াছিন নূরী আল-ক্বাদেরী
খতিব, দারোগাবাড়ী জামে মসজিদ, কুমিল্লা


ইসলামি জগতে ঐতিহাসিক হৃদয় কাঁপানো দিবস পবিত্র মে’রাজ দিবস। মুসলিম জীবনে খুব আগ্রহে লালনীয় ও পালনীয় দিবস হওয়ার কথা ছিল মে’রাজ দিবস। কিন্তু দুঃখের হলেও সত্য যে, অমুসলিমদের অপসংস্কৃতির কড়াল গ্রাসে এমনকি বাংলা মিডিয়া চ্যানেলের নামে মাত্র ধর্মীয় বক্তব্যের কষাঘাতে মুসলিম সমাজ ভুলতে বসেছে মে’রাজুন্নবী কে। কচি কাচা শিশুদেরকে পর্যন্ত পদভ্রান্ত করছে বিশ্ব ভালবাসার নামে নগ্ন ছবি প্রদর্শন করে করে আজ ঘরে ঘরে পৌছে দেওয়া হচ্ছে বিশ্ব বন্ধু দিবস, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস এই চলমান অপসংস্কৃতির ফাঁকে এক সময়ে বের হবে বিশ্ব মুসলিম ঘুম দিবস। শয়তান চট করে সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে আসল সিদ্ধি হাসিল করে ফেলবে। (নাউযুবিল্লাহ)।
প্রিয় পাঠক! গভীর খেয়াল ঐ সব ভ্রান্ত সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে হলে ইসলামি কালচারাল আইডোলজিকে ফলো করা ছাড়া মুক্তির বিকল্প কোন পন্থা নাই। আসলে যে যাহাই বলুক আমরা মুসলমান নামাজি মুমেন মুত্তাকী হিসাবে হযরত আবু বকর ছিদ্দিক এর মত পরম বিশ্বাসী চিত্র বাস্তবায়নে কিছুটা চেষ্টা অব্যাহত রাখি, হয়তবা আখেরাতে নাজাতের পথ সুগম হবে। এই মহান প্রত্যয়ে পবিত্র মে’রাজ ও নামাজ প্রসঙ্গে ক্ষুদ্র পরিসরে পাঠক মহলের হাতে তুলে ধরা। নিতান্তই ধর্ম সেবা অন্য কোন খেয়াল নেই। তাই সমালোচনার মনোভাবকে পায়ের নীচে রেখে দয়াল নবীজির মিরাজ শরীফ ও নামাজ প্রসঙ্গকে জ্ঞানের শীর্ষে রেখে খোলামনে ধ্যান সাধনা মুরাকাবায় নিমগ্ন মনে মিরাজ শরীফের বিশাল রহস্যকে অনুধাবন করুন। আরবী উরূজ ‘আইন’ ‘রা’ ‘জ্বীম’ এই তিনটি অক্ষরের শব্দ মূল থেকে উদ্ধৃত ইসলামি শরীয়তের পরিভাষায় উপরের দিকে চলমান হওয়ার যন্ত্র বা বাহনে অগ্রগামী হওয়াকে মে’রাজ বলে। আর হাকীকতে স্বয়ং আল্লাহর সাথে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার সাক্ষাত বা দিদার কে মে’রাজ বলে। এই মে’রাজ এত বেশী আশ্চর্যকর। এর বিশদ বর্ণনা উপস্থাপন করার পূর্বে স্বয়ং আল্লাহপাক আশ্চর্য বোধক শব্দ ‘ছোবহান’ ব্যবহার করে জগত বাসীকে কিয়ামত পর্যন্ত হতবাককারী কালাম উপস্থাপন করেছেন সূরা বনি ইসরাঈল এর ১৫ পারার প্রথম আয়াতে এরশাদ ফরমান: “ছুবহানাল্লাজী আসরা বিআবদিহি লাইলাম মিনাল মাসজিদিল হারামী ইলাল মাসজিদিল আকসাহ”। অর্থাৎ পরম পবিত্র আল্লাহ তাঁর নিজস্ব আবদকে রাত্রিকালীন মক্কা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস ভ্রমণ করায়েছেন। স্বয়ং আল্লাহপাক হযরত জিব্রাঈল (আঃ) এর মাধ্যমে বুরাক পাঠালেন এত সুন্দর বুরাকে চড়ে বসার আগে মহান আল্লাহ থেকে নিশ্চিত হয়ে নিলেন নবীজি যে আমার উম্মতের জন্য এমন চমৎকার বুরাকের ব্যবস্থা আছে কিনা? বার্তা এসেছে এর চেয়ে আরো সুন্দর বুরাকের ব্যবস্থা রয়েছে। খাঁটি উম্মতকে বেহেস্তে পৌছে দেবে। তখনই নবীজি কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলেন আমার উম্মত গুনাহগার কেমনে হবে পাড়। দয়াল নবীজির এই কালামকে পুর্নরূপ প্রদানের সুবিধার্থে উম্মতের নাজাতের জন্য আল্লাহ পাক ৫০ ওয়াক্তের সমপরিমাণ দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ব্যবস্থা প্রদান করেছেন। কোন উম্মত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পড়লে পঞ্চাশ ওয়াক্তের ছাওয়াব পাবে। উপরন্তু দৈনিক পাঁচ বার আল্লাহ পাক বান্দার সাথে সাক্ষাত করবেন।
শবে মেরাজের ঘটনা ঘটেছে রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাত। তাই পবিত্র কোরআনে লাইলুন অর্থাৎ রাত্রিকে বুঝানো হয়েছে।  ২৭ বৎসরের ভ্রমণকালে বহু নিদর্শনাবলী প্রদর্শন করায়ে মহান আল্লাহপাক আনন্দঘন পরিবেশে ডেকে বলেন, হে পেয়ারা হাবীব! আপনি খুশী হলেন না কি রাগ করলেন? দয়াল নবীজি উত্তরে বলেন হে প্রভূ আপনি আমাকে যত নিকটে এনেছেন অন্য কাউকে এত কাছে আনেননি। এজন্যে খুশী হলাম। কিন্তু দুনিয়ার এতিম উম্মতেরা তো আপনার নিকটে আসতে পারলো না। অমনি আল্লাহ পাক বললেন চিন্তা করবেনা, আপনি সরাসরি সাক্ষাত করেছেন মেরাজে এসে আর আপনার উম্মত যদি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে তাহলে আমি আল্লাহ আপনার নামাজী উম্মতের সাথে দৈনিক পাঁচবার সাক্ষাত করব। অতএব একজন পাক্কা মুসলমান হিসাবে মৃত্যু পর্যন্ত মনে রাখতে হবে নামাজ মে’রাজ ও মূল্যবান চাবী হারা নাভী ছিড়ে ফেলার জন্য মরদুদ শয়তান বহু পায়তারা করবে আশা করি মে’রাজুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার প্রেক্ষাপটে নামাজের কথা কেউ যেন কাজের বাহানা দিয়ে ভূলিয়ে ফেলতে না পারে, কাজকে বলি এখন নামাজ আছে। নামাজকে বলবো না এখন কাজ আছে। যেই কোন মূল্যের উর্ধ্বে রাখবো মোরা নামাজের ওয়াক্তকে যেখানেই আজান শুনবো সেখানেই গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভারকে এক্বামত দিয়ে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করে ফেলবো অফিস আদালত ব্যবসা বাণিজ্য এমনকি কৃষি খামারে নামাজ আদায় করা, ঐ রকম নামাজির বরকতে সব কিছুতে কল্পনার বাহিরে ফজিলত পাওয়া যাবে। এটাই হবে পবিত্র মেরাজের মহান শিক্ষা। রোজা রাখবে দিনের বেলায় নফল নামাজ পড়ব রাত্রিকালীন। পারলে ভাল ভাল খাবার দান করব। যদি পারা যায় ১০০ রাকাত সালাতুল খায়ির এর নামাজ পড়ব। যুগে যুগে আল্লাহ ওয়ালা বুজুর্গগণ এই আমল করে নেক বান্দার মর্যাদার ভাগী হয়েছেন। ঈমাদারগণের ঈমানী জজবায় আঘাত আসবে এমন সব উদভট কথা বক্তব্য না দিয়ে আল্লাহ নবীর মহব্বত বৃদ্ধি পায় এমন কিছু তথ্য বহুল অবদান রাখা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর দায়িত্ব এবং কর্তব্য রয়েছে। কারণ ফেতনা ফ্যাসাদ বৃদ্ধি করা মানেই জঙ্গীবাদকে সাহায্য করা। অন্তকোন্দল পরিহার করলে বিশ্বজগতে মুসলিম সভ্যতা প্রসার হবে। এতে সামগ্রিকভাবে মুসলিম সমাজ সুখী সমৃদ্ধশালী ও বিশ্ব সমাজ গড়তে সহায়ক হবে। নবীজির মে’রাজ রহস্য সফল ও নামাজ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। আমিন।

 
“নবীজি সকল মানুষের সব জাতির ও সমগ্র সৃষ্টির”
পীরে তরীক্বত মাও. শামছুদ্দোহা বারী আলক্বাদেরী
কাঠালিয়া দরবার শরীফ, লাকসাম, কুমিল্লা।


عن على بن ابى طالب رضى الله عنه قال كنت مع النبى صلى الله عليه وسلم بمكة فخرجنا فى بعض نواحيها فما استقبله جبل ولاشجر الا وهو يقول السلام عليكم يارسول الله (رواه الترمذى والدرامى والحاكم)
অনুবাদ: হযরত আলী ইবনে আবি তালেব রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি মক্কা শরীফে নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লামের সফরসঙ্গী ছিলাম। আমরা সেখানকার একটি জনপদ দিয়ে যাচ্ছিলাম। আর চলার পথে পাহাড়-পর্বত, গাছ-পালা যা সামনে পড়ছে সবকিছুই উচ্চারণ করছে ‘আস্সালামু আলায়কা ইয়া রাসূলাল্লাহ’ (তিরমিযী শরীফ, দারেমী শরীফ)
প্রাসঙ্গিক আলোচনা:
আমাদের প্রিয় নবী হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কেবল নির্দিষ্ট জাতি কিংবা নির্দিষ্ট সৃষ্টির জন্য প্রেরিত হয়নি; বরং তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বভ্রমাণ্ডের জন্য নবী এবং রহমত। ইরশাদে বারী তায়ালা-وما ارسلنك الا رحمة للعالمين  (সূরায়ে আম্বিয়া)।
এ জন্য শায়ের বলেন:
জাঁহা তক হ্যায় রবুবিয়ত ও খোদা কি
ওহাঁ তক হ্যায় নবুওয়াত মুস্তাফাকি
অর্থ: যেথায় আছে আল্লাহর প্রভূত্ব - সেথাও মোস্তফা (সঃ)-এর নবুওয়তের অন্তর্ভূক্ত।
তিনি যেমনি মানব জাতির নবী ছিলেন, তেমনি ছিলেন জিন জাতিরও। জীব-জড় সকল পদার্থের উপর তাঁর নূরানী প্রভাব বিস্তৃত ছিল সমান ভাবে। জন্তু জানোয়ার, পশু-পাখি, মাছ এমনকি কীট পতঙ্গ পর্যন্ত তাঁর বিশাল মর্যাদার ব্যাপারে ওয়াক্বিফহাল ছিল। তাই চলার পথে এরা নবীজির সম্মানে রুখে পড়ত ও সালাম পেশ করত। আলোচ্য হাদীসে পাকে পাহাড় ও গাছপালার পক্ষ হতে নবীজীর প্রতি সালাম প্রদানের প্রমাণ পাওয়া যায়।
বনের বাঘ নবীজীকে ভালবাসত:
عن محمد بن المنكدر ان سفينة مولى رسول الله صلى الله عليه وسلم اخطأ الجيش بارض الروم او ايسر فانطلق هاربا يلتمس الجيش فاذا هو بالاسد فقال يا ابا الحارث انا مولى رسول الله صلى الله عليه وسلم كان من امرى كيت وكيت فاقيل الاسد له بصبصه حتى قام الى جنبه كلما سمع صوتا اهوى اليه ثم اقبل يمشى الى جنبه حتى بلغ الجيش ثم رجع الاسد : مشكوة شريف: ص:৫৪৫)
অনুবাদ: হযরত মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদির রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্নিত তিনি বলেন, একদা রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লামের গোলাম হযরত সফীনা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রোম সম্রাজ্যে মুসলিম সৈন্যবাহিনীর কাছে পৌঁছার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলেন অথবা কোন যুদ্ধে বন্দীশালা হতে বের হয়ে সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে দৌড়াচ্ছিলেন এমতাবস্থায় হঠাৎ একটি বাঘ সামনে হাজির। তিনি বাঘকে সম্বোধন করলেন হে আবুল হারেছ (আরবী ভাষায় বাঘের উপনাম) আমি রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াসাল্লামার গোলাম। অত:পর এমন অবস্থা হল যে, ওই বাঘটি কুকুরের মত নি:শ্বাস ফেলতে ফেলতে নিকট আসল। এক পর্যায়ে তারঁ এক পাশে এসে অবস্থান নিল আর যখনই কোন জন্তুর আওয়াজ শুনে তৎক্ষনাৎ সেদিকে দৌড়ে যায় আবার ফিরে আসে। এভাবে সম্মুখপানে যেতে যেতে সৈন্য বাহিনী পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন। অত:পর বাঘ ফিরে গেল। (মিশকাত শরীফ: ৫৪৫পৃষ্ঠা)
উপরে উল্লেখিত দুইখানা হাদিস শরীফ থেকে প্রমাণ হল যে, রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সমগ্র সৃষ্টির নবী। আর সমগ্র সৃষ্টি তাঁর প্রেমিক। যদিও কিছু কিছু মানুষ তা বুঝে না।
শায়ের বলেন:
উচ্চারণ:    ছে জুয়ী? ছে জুয়ী? মেছালে মুহাম্মদ (দ:)
    না ইয়াবী না ইয়াবী মেছালে মুহাম্মদ (দ:)।
অর্থ:    কি অন্বেষণ কর তুমি মুহম্মদের সমতুল্য
    পাবেনা কভু কোথাও তাঁর উপমাতুল্য।


ছায়াহীন কায়া নিয়ে ধরায় এলেন নূরের নবী মুস্তফা ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
মাওলানা আলা উদ্দিন আল্ ক্বাদেরী
প্রভাষক, বদরপুর সিনিয়র মাদ্রাসা, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর।


ছায়া বিহীন কায়া (শরীর মোবারক) নিয়ে এই ধরাধামে তাশরীফ আনলেন- হায়াতুন্নবী, নূরের নবী আহমদ মুজতাবা মুহাম্মাদ মুস্তফা ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সেই নূর নবীর পবিত্র কদমে গোলামদের লাখো সালাম। রাসূলে পাক ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র শরীরে ছায়া ছিলনা, তাই আরবীতে তাঁকে বলা হয় “নূরে মুজাচ্ছাম” বা নূরের শরীর। নূর শব্দের একটি অর্থ হলো “আলো”। আলোতো শুধু ছায়া দূর করে। আলো কখনো অন্ধকার বা ছায়ায় ঢাকা পড়েনা। এজন্য মহান আল্লাহ্ পাক বলেন- “ক্বদ জা-আকুম মিনাল্লা-হি নূর”। অর্থ:- আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের মাঝে এসেছে এক নূর। (সূরা মা-ইদাহ, আয়াত:১৫)
উম্মত দাবীদার অনেক মানুষই এই বিষয়টা সম্পর্কে বিতর্ক করে বিধায় এ ব্যাপারে যৎসামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
ড. আল্লামা শাইখ মানযুর আহমাদ রেফায়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেন-
নবীর নাই শরীরের ছায়া/ নবীর আছে নূরের কায়া/ ছায়া ছাড়া কায়ার মায়ায় মুমিন হয় তন্ময়/ আমার মত মানুষ নবী কাফেরেরা কয়।
দলীল নং- ১) হাদীস শরীফে আছে- হযরত যাকওয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন- নিশ্চয়ই সূর্য ও চাঁদের আলোতে রাসূলে পাক ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামামের ছায়া মুবারক দেখা যেতনা। (নাওয়াদিরুল উছূল কৃত বিখ্যাত মুহাদ্দিছ আল্লামা হাকীম তিরমিযী র:)।
২) উক্ত হাদীসখানা রয়েছে- “খাছা-ইছুল কুবরা” নামক কিতাবে। যার লেখক ইমামুল মুহাদ্দিসীন, সুলতানুল আরেফীন, হযরত ইমাম জালালুদ্দীন সূয়ূতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি।
৩) “নিশ্চয়ই নূরে মুজাসসাম নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ছায়া জমিনে পড়ত না। কেননা তিনি ছিলেন আপাদমস্তক নূর। অত:পর তিনি যখন সূর্য বা চাঁদের আলোতে হাঁটতেন তখন উনার ছায়া দৃষ্টি গোচর হতনা”। (দেখুন শিফাউল ছুদূর, কৃত বাহরুল উলূম, শাইখুল মাশায়িক আল্লামা ইবনে সাবা রহমাতুল্লাহি আলাইহি।)
৪) “চাঁদ ও সূর্যের আলোতে ও রাসূলে পাক ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছায়া দৃষ্টি গোচর হতনা। কেননা তিনি ছিলেন নূর”। (দেখুন- শরহে মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া শরীফ, কৃত- বিখ্যাত ব্যাখ্যাকার হাফিযুল হাদীস, আওলাদে রাসূল আল্লামা ইমাম যুরকানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি।)
৫) “রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছায়া জমীনে পড়ত না। চাঁদ বা সূর্যের আলোতেও উনার ছায়া দেখা যেতনা”। (দেখুন- আল মু’জামুল লবীব ফী খাছাইছিল হাবীব, ২য় বাব চতুর্থ অধ্যায়, কৃত- আল্লামা সুয়ূতী রহ.)।
৬) “রাসূলে পাক ছাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের দেহের ছায়া সূর্য ও চাঁদের আলোতেও পড়তনা। কেননা তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নূর”। (দেখুন- শিফা শরীফ, কৃত- মুহাদ্দিছুশ শাহীর, ফক্বীহুল আছার, আল্লামা ইমাম কাযী আয়ায (রহ:)।
৭) “নিশ্চয়ই রাসূলে পাক ছাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম ছিলেন নূর। নিশ্চয়ই তিনি যখন চাঁদ ও সূর্যের আলোতে হাঁটতেন তখন উনার ছায়া প্রকাশ পেত না”। (দেখুন- “আফদ্বালুল কুরা” লেখক- ওলীয়ে কামেল আল্লামা ইমাম ইবনে হাজার মক্কী রহ.)।
একই কথা লিখেছেন- ৮) “নাসীমুর রিয়াদ্ব” কিতাব বিখ্যাত মুহাদ্দিছ আল্লামা শিহাবুদ্দীন খাফফাজী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ।
৯) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন- রাসূলে পাক ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহ মুবারকের কোন ছায়া ছিল না। উনার নূরের উজ্জলতা সূর্য ও বাতির আলোর উপর প্রাধান্য পেত”। (দেখুন- কিতাবুল ওয়াফা)।
১০) “মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীনের কী করে ছায়া পড়তে পারে? ছায়াতো তিনিই সৃষ্টি করেছেন। তবে কি উনার কোন মিছাল রয়েছে? তবে কি তিনি কামালে লাতাফাতের অধিকারী নন? দেখুন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম ‘কামালে লাতাফাত’ এর অধিকারী হওয়ার কারণে উনার দেহ মোবারকের ছায়া পড়তনা”। (দেখুন- মাকতুবাত শরীফ, কৃত-  ক্বাইউমুজ্জামান আফদ্বালুল আওলিয়া, আবুল বারাকাত, খাযীনাতুর রহমাত, শাইখ আহমাদ ফারুকী সিরহিন্দী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি।)
১১) যারকানী শরীফ ৪র্থ খন্ড ২২০ পৃষ্ঠায় ও অনুরূপ উল্লেখ আছে।
১২) আ‘লা হযরাত, আযীমুল বারকাত, ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা শাহ্ আহমাদ রেযা খান ফাযেলে বেরেলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেন-
তুহে ছায়াহ নূর কা ফর আদ্দু টুকরা নূর কা
ছায়াহ কা ছায়াহ না হোতা হে না ছায়াহ নূর কা।
অর্থ: “হে প্রিয় রাসূল। আপনিতো নূরের প্রতিচ্ছবি বা ছায়া। আপনার প্রতিটি অঙ্গই এক একটি নূরের টুকরা। নূরের যেমন ছায়া হয়না, তদ্রুপ ছায়ার ও প্রতিচ্ছায়া হয়না।” কাজেই আপনার ও প্রতিচ্ছায়া নেই কেননা আপনি নূর এবং নূরের ছায়া। (হাদায়েকে বখ্শিশ ২য় খন্ড ৭ম পৃষ্ঠার ছন্দ)
১৩) সুন্নীয়তের দলীল অধ্যক্ষ হাফেজ আল্লামা এম, এ জলীল রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর নূর নবী নামক গ্রন্থের ১৩নং পৃষ্ঠায় এ ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।
১৪) ওহাবী নেতা আশ্রাফ আলী থানভী সাহেব বলেন- অর্থ- “একথা সর্বজন স্বীকৃত ও প্রসিদ্ধ যে, আমাদের হুযূর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেহের ছায়া ছিলনা। কেননা আমাদের হুযূর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথা মোবারক হতে পা মোবারক পর্যন্ত শুধু নূর আর নূর ছিলেন”। (শুকরুন্নিআমত বিযিকরি রহমাতির রহমাত পৃষ্ঠা নং-৩৯)।


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
শাহানশাহে চিশতি খাজা আজমেরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু
মোহাম্মদ এনায়েত মোর্শেদ বুলবুল


আস্সালাতু ওয়াস্সালামু আলাইক, আলাইকা ওয়া আলা আলিকা ওয়া আসহাবিক ওয়া খাওয়াস্সে আউলিয়ায়ে উম্মাতিকা ওয়া ওয়ারেসে মাকামিকা ওয়া হালিক, ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম।
মাওলায়ে দোজাহাঁ সাইয়্যেদেনা রাসুলে করিম রাহমাতাল্লিল আলামিন (সাঃ) এঁর খায়রুল উম্মতগণের মধ্যে অন্যতম হলেন হিন্দুস্তানের আউলিয়াগণের অবিসংবাদিত সম্রাট খোদাপ্রেমিকগণের সেরতাজ, গরীবে নওয়াজ, খাজায়ে খাজেগান হযরত খাজা মঈনুদ্দীন আজমেরী চিশতি সাঞ্জারী (রাঃ)। ভারতবর্ষে দীনে মুস্তফা (সাঃ) প্রচারে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ সিপাহ্সালার। তাঁর আগমনের খোদায়ী করুণা ও দানের যে বর্ষণ শুরু হয়েছে তা আজও বহমান। হিন্দুস্থানের দোর্দন্ড প্রতাপশালী রাজপুত রাজা পৃথিরাজ চৌহানের সকল ঐন্দ্রজালীক ক্ষমতা ষড়যন্ত্র ও কুটজাল প্রতিরোধ করে শুধু বহু লোককে ইসলামের সুশীতল ছায়া তলেই আনেননি বরং আল্লাহ জাল্লাশানুহুর দানকৃত ঐশী গুণাবলীর মোহনীয় সৌন্দর্যে বহু অমুসলিমের হৃদয়ও জয় করেছেন। যে কারনে তার মহান দরবারে শুধু মুসলমানই নয় বরং সর্ব ধর্ম-বর্ণের লোকের অবাধ যাতায়াত করতেন। ঐতিহাসিক বর্ণনা মতে সে সময় সাইয়্যেদুনা খাজায়ে আজমেরী (রাঃ) এর বরকতে প্রায় ৯০ লক্ষ লোক ইসলামের ছায়াতলে এসেছিল।
আলে নবী (সা.) আওলাদে আলী (রাঃ) সাইয়্যেদুনা খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি হাসান সাঞ্জারী (রাঃ) এঁর জন্ম তারিখ ১৪ ই রজব নিয়ে কোন মতভেদ না থাকলেও তাঁর জন্ম সন নিয়ে মতভেদ আছে। বিভিন্ন গ্রন্থকারগণ হযরত খাজা বাবা (রাঃ) এর জন্ম সন হিসেবে ৫২৩/ ৫৩০/ ৫৩৬/ ৫৩৭ হিজরী সনকে উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে অধিকাংশ নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে ৫৩০ হিজরী সন এবং জন্মস্থান হিসেবে সাঞ্জারকে নির্ধারণ করা হয়েছে (সিয়ারুল আউলিয়া, নোফহাতুল উনস, তারিখুস্সালাফ, হামারী খাজা, খাজিনাতুল আসফিয়া)। খাজা বাবার পিতৃ পুরুষ বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে ইরাকের বাসস্থান থেকে খোরাসানের সিজিস্থান বা সিস্তান প্রদেশের সাঞ্জারে বাসস্থান নির্ধারণ করেন। এখানেই প্রখ্যাত বুজুর্গ খাজা সৈয়দ গিয়াসুদ্দীন হাসান সাঞ্জারী (রা.) এঁর ঔরসে এবং সাইয়্যেদা হযরত উ¤মূল ওয়ারা মাহিনূর (রাঃ) এঁর গর্ভে খাজায়ে খাজেগান খাজা আজমেরী (রাঃ) জন্মগ্রহণ করেন। হযরত খাজা আজমেরী (রাঃ) পিতৃকূলের দিক থেকে হোসাইনী এবং মাতৃকূলের দিক থেকে হাসানী। সাইয়্যেদেনা হুজুর গাউসে আযম বড়পীর মহিউদ্দীন আবদুল ক্বাদের জিলানী (রাঃ) এবং গরীবে নেওয়াজ খাজা আজমেরী (রাঃ) নিকটাত্মিয়তার সম্পর্কসূত্রে মামা-ভাগিনা। গাউসে আযম (রাঃ) এঁর পিতামহ সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ হাম্বলী (রাঃ) এঁর দুই পুত্র ছিলেন (১) সাইয়্যেদ আবু সালেহ মূসা জঙ্গি (রাঃ) (২) সাইয়্যেদ দাউদ মক্কি (রাঃ)। গাউসে আযম (রাঃ) এঁর পিতা হলেন আবু সালেহ মূসা জঙ্গি (রাঃ) এবং খাজা বাবা (রাঃ) এর মাতা সাইয়্যেদা উ¤মূল ওয়ারা মাহিনূর ছিলেন সাইয়্যেদ দাউদ মক্কি (রাঃ) এর কন্যা। এ সূত্রে গাউসে আযম (রাঃ) এবং খাজা বাবা (রাঃ) এর মাতা চাচাত ভাই-বোন ছিলেন এবং খাজা বাবা (রাঃ) হলেন গাউসে আযম (রাঃ) এর ভাগিনা। এখানে উল্লেখ্য যে, হুজুর গাউসে আযম (রাঃ) যখন ঘোষনা করেছিলেন, “আমার এই কদম সকল আউলিয়া আল্লাহর গর্দানে।” তখন খাজা বাবা খোরাসানের জঙ্গলে সাধনারত অবস্থায় সর্ব প্রথম স্বীকৃতি দিয়ে বলেছিলেন-“ হে গাউসে আযম আপনার কদম শুধু আমার গর্দানে নয়, আমার চোখে আমার মাথায় ও চোখের মনিতে।”
হযরত খাজা বাবা (রাঃ) শিক্ষা জীবন তাঁর বুজুর্গ পিতা সাইয়্যেদ খাজা গিয়াসুদ্দীন হাসান সাঞ্জারী (রাঃ)এর নিকট স্বগৃহেই আরম্ভ হয়। এ সময় মোঙ্গলদের বর্বরতার কারনে সাঞ্জার ত্যাগ করে তাঁরা খোরাসানে বসবাস শুরু করেন। বুজুর্গ পিতার সান্নিধ্যে ও তত্ত্বাবধানে আরবি ব্যাকরণ, সাহিত্য,ইফক্হ, তাফসির , হাদীস শিক্ষা ছাড়াও খাজা বাবা (রাঃ) মাত্র নয় বৎসর বয়সে তরজমাসহ কোরানুল করিম হেফজ করেন। খোরাসানের মাদ্রাসায় তাঁকে ভর্তি করা হলে বুজুর্গ পিতার তত্ত্বাবধানে মাত্র ১৩ বৎসর বয়সে সেখানকার শ্রেষ্ঠত্বের সনদ লাভ করেন।
সমগ্র বিশ্বের খালিক ও মালিক আল্লাহ সুবহানুহু তায়ালার অমোঘ নিয়মে খাজা বাবার ১৪/১৫ বৎসর বয়সে ৫৪৪/ ৫৪৫ হিজরি সনে ১৫ ই শাবান তাঁর স্নেহশীল বুজুর্গ পিতা সাইয়্যেদ গিয়াসুদ্দীন হাসান সাঞ্জারী ইন্তেকাল করেন। একই বৎসরের মধ্যে খাজা বাবার স্নেহশীল মাতাও ইন্তেকাল করেন। পিতা-মাতার ইন্তেকালের পর খাজা বাবা (রাঃ) মিরাস সূত্রে একটি আটা পেষণ করার যন্ত্র ‘যাঁতা’ ও একটি ফলের বাগান লাভ করেন। একদা খাজা বাবা (রাঃ) নিজ বাগানের তত্ত্বাবধান করছিলেন। এমন সময় তৎকালের প্রখ্যাত দরবেশ হযরত ইব্রাহিম কান্দুজী (রাঃ) এসে বাগানে উপস্থিত হন। আল্লামা জামী তাঁর নোফহাতুল উনস গ্রন্থে ইব্রাহিম কান্দুজী (রাঃ) এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। হযরত খাজা বাবা (রাঃ) অত্যান্ত বিনয় ও আন্তরিকতার সাথে তাঁকে একটি গাছের ছায়ায় বসিয়ে সুমিষ্ট আঙ্গুর পরিবেশন করে তাঁর সম্মুখে উপবেশন করলেন। ইব্রাহীম কান্দুজী (রাঃ) খাজা বাবার মনোহরা বিনয়, সুন্দর সু-স্বভাব এবং কাশ্ফ দ্বারা আজলী যোগ্যতা দর্শন করে সন্তুষ্ট চিত্তে আঙ্গুর খেলেন এবং তাঁর স্বীয় ঝোলা হতে এক টুকরা রুটি বা অন্য কোন খাদ্য বের করে চিবিয়ে নিজ হাতে খাজা বাবার মুখে তুলে দিলেন। খাজা বাবাও অত্যন্ত সম্মানের সাথে তা খেয়ে ফেললেন। খাওয়ার সাথে সাথেই খাজা আজমেরী (রাঃ) এঁর অন্তর রাজ্যে আল্লাহ প্রেমের মহান উচ্ছাস আন্দোলিত হয়ে উঠল। সংসারের যাবতীয় মোহ-মায়া তাঁর হৃদয় থেকে তিরোহিত হল। তিনি যাঁতা এবং বাগান বিক্রয় করে সমুদয় অর্থ গরীব দুঃখিদের মাঝে বিতরণ করে উচ্চতর জ্ঞান আহরণ করার জন্য গৃহত্যাগ করে ভ্রমনে বের হলেন।
খাজা বাবা সে সময়ের ইসলামী শিক্ষার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র সমরকন্দ ও বোখারায় তাফসির, ফিক্হ শাস্ত্র, হাদীস এবং অন্যান্য ইলমে জাহেরী জ্ঞানে অধিকতর পারদর্শিতা অর্জন করেন। সমরকন্দের প্রখ্যাত ফেকাহবিদ হযরত মাওলানা শরফুদ্দিন (রাঃ) এবং বোখারার প্রখ্যাত মোহাদ্দেস হযরত মাওলানা হেসামুদ্দীন (রাঃ) এঁর নিকট পাঁচ বৎসর শিক্ষা জীবন অতিবাহিত করে সনদ লাভ করেন। প্রায় বিশ বৎসর বয়সে খাজা বাবা পাঠ্য জীবন শেষ করে একজন পীরে কামেলের সন্ধানে দেশভ্রমনে বের হন। এ সময় তিনি মুসলিম জাহানের বহু স্থান এবং অনেক বুজুর্গের দরবারে গমন করেন। পরিশেষে খাজা বাবা বায়াত গ্রহণ করেন সাইয়্যেদেনা হযরত খাজা ওসমান হারুনী (রাঃ) এর পবিত্র হাতে। তাঁর বায়াত গ্রহন সংক্রান্ত খাজা বাবার স্বীয় জবানীতে বর্ণনা করা ঘটনা এবং আরও কতিপয় বিষয় আনিসুল আরওয়া, সিররুল আরেফিন , সিয়ারুল আকতাব ,হামারী খাজা প্রভৃতি গ্রন্থে বর্ণিত আছে। হযরত খাজা আজমেরী (রাঃ) পীরের সাথে হজ্জব্রত পালনসহ বহু জায়গায় সফর করেন। কোন কোন ঐতিহাসিক এবং জীবনী লেখকগণের মতে খাজা বাবা সর্বমোট ২০ বৎসর ছয় মাস বা চার মাস পীরের খেদমতে ছিলেন। কাহারো মতে আড়াই বৎসর একাধারে খেদমতের পর দেশ ভ্রমণ ও বুজুর্গগণের সান্নিধ্য অর্জনের নির্দেশ পান। পীরের নির্দেশে দেশ ভ্রমণে বের হয়ে খাজা বাবা (রাঃ) সাইয়্যেদেনা পীরানে পীর গাউসুস সাক লাইন হযরত মুহিউদ্দিন আব্দুল কাদের জিলানী (রাঃ), হযরত শেখ নাজমুদ্দীন কুবরা (রাঃ) , হযরত শেখ আবু সাইদ তাবরীজি (রাঃ) সহ সম-সাময়িক প্রখ্যাত বুজুর্গগণের সাক্ষাত লাভ করেন।
আতায়ে রাসুল (সাঃ) শাহানশাহে চিশতি খাজা আজমেরি রাসূলে পূরনূর (সাঃ) হতে প্রত্যক্ষ নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে লাহোর, দিল্লী হয়ে ৫৮৭ হিজরি সনে আজমির পদার্পন করেন। সে সময়ের পৌত্তলিকতার প্রাণকেন্দ্র আজমিরের রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহান তার জাদু বিদ্যায় সর্বশক্তি এবং কুটচাল দিয়ে খাজা বাবার বিরোধিতা করতে থাকে। কিন্তু সে খাজা বাবার আধ্যাত্মিক শক্তির কাছে ব্যর্থ মনোরথ হয়। বরং তার রাজগুরু রামদেব এবং শ্রেষ্ঠ যাদুকর অজয় পাল ও অন্যান্য বহুলোক খাজা আজমেরি (রাঃ) হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। এক পর্যায়ে খাজা বাবার রুহানী সহায়তায় শিহাব্দ্দুীন মোহাম্মদ গোরি আজমির জয় করেন এবং পৃথ্বিরাজকে বন্দি ও হত্যা করেন। ভারতবর্ষের পৌত্তলিকার প্রাণকেন্দ্র আজমির খাজা বাবার দ্যুতিময় পরশে হয়ে উঠল আধ্যাত্মিকতার অফুরন্ত ভান্ডার।
তারিখে ‘আইনায়ে তাসাউফ’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, “ হযরত খাজা গরীবে নওয়াজ আজমেরি (রাঃ) কর্তৃক ৬৪৬০টি কারামত প্রকাশিত হয়েছে।” গোলেস্তান প্রণেতা উল্লেখ করেছেন, “ আজমিরে আসার পূর্বেই খাজা বাবার ১৬ হাজার কারামত প্রকাশিত হয়েছিল।” প্রকৃতপক্ষে খাজায়ে খাজেগান দাতা আজমেরি (রাঃ) এর কারামত সংখ্যা অসংখ্য। কারণ এখনও প্রতিদিন খাজায়ে আজমেরি (রাঃ) এর কারামত প্রকাশিত হচ্ছে এবং ইনশাল্লাহ হতে থাকবে।
খাজা বাবার খলিফাগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন হযরত খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রাঃ)। প্রধানত তাঁর শাজরা পরম্পরাতেই চিশতিয়া ত্বরিকা সবচেয়ে বেশি প্রচার ও প্রসার লাভ করেছে।
সুলতানে চিশতিয়া হযরত খাজা আজমেরি (রাঃ) এঁর ইন্তেকাল সন ও তাঁর বয়সকাল নিয়ে মতভেদ থাকলেও ৬ ই রজব রাতে তাঁর ইন্তেকালের বিষয়ে কোন মতানৈক্য নেই। বর্ণিত আছে তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর জ্যোতির্ময় ললাটে আলোক অক্ষরে লিপিবদ্ধ ছিল, “ হাজা হাবিবিল্লাহ মা’তাফি হোব্বিল্লাহ।” অর্থাৎ “ ইনি আল্লাহর বন্ধু আল্লাহ প্রেমেই প্রাণ দান করেছেন।”
নিম্নে খাজা বাবার কতিপয় অমিয় বাণী উল্লেখ করা হলো ঃ
    কোন মুসলমান ভাইকে তুচ্ছ ও হেয় জ্ঞান করিয়া লাঞ্চিত ও কষ্ট দিলে যে ক্ষতি সাধিত হয়, অন্য কোন পাপ কাজ মানুষের তত ক্ষতি সাধন করতে পারে না।
    অলী আল্লাহগণ নূরময়। তাঁহারা সূর্যের মত নিজেদের আলো দ্বারা সমগ্র জগৎ আলোময় করিয়া রাখেন।
    দুনিয়াতে তিনটি বস্তু অত্যন্ত দূর্লভ প্রথমত- অলী আল্লাহগণের অমিয় বাণী। দ্বিতীয়ত- ধন-সম্পদ, ভোগ-লালসার প্রতি নিরাসক্তি। তৃতীয়ত- সর্বক্ষণ আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকা।
    সংশ্রবের প্রভাব অবধারিত। ভালো সংশ্রবের ভালফল ও কু-সংশ্রবের কুফল অনিবার্য। পূণ্যবানের সংশ্রব অন্যান্য পূণ্য কর্ম হইতে শ্রেষ্ঠ এবং পাপীর সংশ্রব পাপ কর্ম হইতে অধিক মন্দ।
‘মঈন উদ্দীন’ শব্দের অর্থ দীনের সাহায্যকারী। আমাদের খাজা বাবা শুধু দীনের সাহায্য কারীই নন তাঁর সাহায্যের হাত এতই প্রশস্ত যে খোদায়ী অনিঃশেষ দানের খাজানা তাঁর মহান দরবার সর্ব রকম সাহায্য প্রত্যাশি সর্ব ধর্মের লোকের মিলন মেলা। গরীবে নেওয়াজ খাজা আজমিরী (রাঃ) এর নেগাহে করম আমাদের উভয় জগতে সার্বক্ষনিক সঙ্গি থাকুক পরম করুণাময়ের দরবারে এটাই বিনীত প্রার্থনা। আমিন সুম্মামিন। বহুরমতে সাইয়্যেদিল মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।


প্রশ্নোত্তর পর্ব
মুফতী মাওলানা মুহাম্মদ ফজলুল কাদের বাগদাদী আলক্বাদেরী
আরবী প্রভাষক, গাজীপুর (হরিপুর) নেছারিয়া ফাযিল মাদরাসা, চাঁদপুর


প্রশ্ন: হাক্কানী পীর হওয়ার জন্য কি কি গুন থাকা আবশ্যক?
মুহাম্মদ রেজাউল করীম, ফকির বাজার, কুমিল্লা।
উত্তর ঃ হাক্কানী পীর হওয়ার জন্য কয়েকটি গুণ থাকা আবশ্যক। যেমন:
*    সময়োপযোগী আলেম হওয়া তথা কোরআন হাদীস, ফিকহ ও তাসাউফ শাস্ত্রে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
*    কামেল পীরের জন্য আত্মিক পবিত্রতা লাভ করা আবশ্যক।
*    রাসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নতের পরিপূর্ণ অনুসারী হওয়া।
*    শুদ্ধ আকীদা সম্পন্ন হওয়া।
*    রাসূল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করে দেয়ার যোগ্যতা সম্পন্ন হওয়া।
*    কামেল পীরের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বোত্তম পরিচয় হল- ফায়েজ বা তাওয়াজ্জু প্রদানের যোগ্যতা থাকা।
পীরানেপীর গাউছে বাগদাদ হযরত বড়পীর শেখ আবদুল কাদের জিলানী (রা) হাক্কানীপীর বা মুর্শিদের জন্য পাঁচটি গুণ থাকা আবশ্যক বলে বর্ননা করেছেন-
*    শরীয়তে পরিপূর্ণ জ্ঞানসম্পন্ন আলেম হওয়া।
*    ইলমে হাকীকত সম্পর্কে পূর্ণজ্ঞান থাকা।
*    সাক্ষাত প্রার্থীর সাথে স্নিগ্ধ ও মার্জিত ব্যবহার এবং প্রফুল্ল বদন ও সন্তুষ্টি চিত্তে দর্শন দান করা।
*    দ্বীন-হীনদের সাথে কথায় ও কাজে নম্রতাপূর্ণ ব্যবহার করা।
*    ভক্তবৃন্দের অন্তরের ব্যাধিসমূহ নির্ধারণপূর্বক তা দূরীকরণের উপায় সম্মন্ধে অভিজ্ঞ হওয়া। নিজেকে রিয়া, হিংসা-বিদ্ধেষ, লোভ-লালসা, গর্ব-অহমিকা ইত্যাদি থেকে মুক্ত রাখা। কর্তব্যকর্মে শৈথিল্য এবং আরামপ্রিয়তা দূরীভূত করা।
খাজা নিজাম উদ্দিন আওলিয়া (রহ:) বলেছেন- পীরকে এমন ক্ষমতাবান ও অন্তর দৃষ্টি সম্পন্ন হওয়া দরকার, যখন কোন ব্যক্তি মুরিদ হওয়ার জন্য আসে তখন সে পীর একটি মাত্র দৃষ্টি নিক্ষেপের মাধ্যমে তার অন্তরের সমস্ত দুনিয়াবী প্রেম ও আবর্জনা এমনভাবে বের করে দিবেন, যেন তার অন্তর স্বচ্ছ আয়নার মত হয়ে যায়। যদি পীরের মধ্যে এমন ক্ষমতা না থাকে, তাহলে তাঁর মুরিদ করানো উচিত নয়। যদি করে তাহলে অপরকে বিভ্রান্ত বা গোমরাহ করার অপরাধে অপরাধী হবে। (রাহাতুল কুবুল পৃ:২৯)
আরেফে কামেল আবদুল ওহাব শরানী (রহ:) তার কিতাব “মানানুল কুব্রা” এর মধ্যে বলেছেন- তরীকতের বুজর্গগণ ব্যাখ্যা করেছেন, তরীকতের পীর হবার ইহাও একটি শর্ত যে, তাঁর মুরিদ যদি হাজার বছরের পথের দূরত্ব হতে ও তাঁকে ডাক দেয় তিনি যেন তা শুনতে পান। (হাকিকত্বে মুহাম্মদী ও মিলাদে আহমদি পৃ:১৭৩) ।

প্রশ্ন: জনৈক বক্তা তার বক্তৃতায় বলে- কোন মানুষকে গাউছুল আজম বলা শিরক, প্রকৃত গাউছুল আজম হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। তার এ বক্তব্য কতটুকু শরীয়ত সম্মত জানতে চাই ?
মুহাম্মদ দিদারুল ইসলাম (বি.এ. অনার্স, গণিত বিভাগ), কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা।
সমাধান: “গাউছুল আজম” প্রদবীটি কি আল্লাহর না মানুষের এ নিয়ে ইদানিং বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কোন কোন নামধারী মুফাস্সিরে কোরআন, বক্তা, মনগড়া বক্তৃতা দিয়ে মানুষের ঈমান, আক্বিদা ধ্বংস করার জন্য বলে গাউছুল আজম শব্দের অর্থ হচ্ছে সর্বশেষ্ঠ সাহায্যকারী। তাই এটা কোন মানুষের বা বড়পীর আবদুল কাদের জীলানীর পদবী হতে পারে না বরং কোন মানুষকে গাউছুল আজম বলা শিরক। প্রকৃত গাউছুল আজম হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। মূলত এরা ধোকাবাজ পীর মাশায়েখ বিরোধী গোত্র, এরা গাউছুছাকালাইন শেখ আবদুল কাদের জিলানী (রা.)-কে গাউছুল আজম বলে মানতে চায় না।
তাদের উক্ত আপত্তিকর জবাব হচ্ছে- আল্লাহ তায়ালার ৯৯ সিফাতি নামের মধ্যে “গাউছুল আজম” নাই। এমনকি বিভিন্ন হাদীস ও সিরাত গ্রন্থে আল্লাহ তায়ালার একহাজার সিফাতী নামের উল্লেখ আছে উক্ত একহাজার নামের মধ্যেও গাউছুল আজম শব্দ উল্লেখ নাই। সুতরাং বুঝা গেল এ পদবীটি আল্লাহর নয়। এটি ইলহামী। আর এটি একমাত্র অলীকুল স¤্রাট শেখ আবদুল কাদের জিলানীর জন্য খাস। অলীগণের বেলায়াতের স্তর হিসাবে সর্বশেষ ও সর্বোচ্ছ পদবীটি হচ্ছে “গাউছুল আজম”।
এই পদবীটি আল্লাহ তায়ালার শানে ব্যবহার করাই বেয়াদবী এবং কুফরী।
“দালায়েলুস-সুলুক” নামক কিতাবে অলীদের স্তর সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে, তাঁদের বিভিন্ন স্তরের নাম যেমন ১। গাউস ২। কাইউমুজ্জামান ৩। কুতুব ৪। আখইয়ার ৫। আবরার ৬। নুজাবা ও ৭। নকীব।
আল্লামা জালাল উদ্দিন সুমূতী (রহ.) আলহাবী লিল-ফাতওয়া” নামক কিতাবে ২৫০ পৃষ্ঠায় বলেন- ইবনে আসাকির হযরত হাসান বসরী (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন সত্তরজন ছিদ্দিক থেকে এ পৃথিবী কখনো শূণ্য হয়না এবং তাঁরা সকলেই হলেন আবদাল, তাঁদের মধ্যে যখনই কোন একজন বিদায় হয়ে যান। আল্লাহ তায়ালা অনুরূপ একজনকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে দেন। তাদের মধ্যে চল্লিশজন শামে অবস্থান করেন এবং ত্রিশজন সারা পৃথিবীতে বিচরণ করেন। তিনি (আল্লামা জালাল উদ্দীন সুয়ুতী (র:) আরো বলেন- ইবনে আসাকির এবং খতিব উবাইদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ আল আবাসী এর সনদে বর্ননা করেন তিনি বলেন আমি কেনানীকে বলতে শুনেছি যে, পৃথিবীতে অলীগনের মধ্যে নকীব তিনশতজন, নজীব সত্তরজন, আবদাল চল্লিশজন, আখইয়ার সত্তরজন, আমাদ বা কুতুব চারজন (এদেরকে আওতাদ বলা হয়) এবং গাউছ একজন। (আলহাবী লিল-ফাতওয়া পৃ. ২৫০)।
প্রশ্ন: কুরআন-হাদীস পড়লেই চলে। পীরের নিকট বয়াত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা কেন?
মুহাম্মদ কাউসার আহমদ, (বি.এ. অনার্স), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
উত্তরঃ ইসলামে বাহ্যিক জীবন ব্যবস্থার নাম শরীয়ত। আর শরীয়াতের আওতায় থেকে আত্মিক উৎকর্ষতা সাধন ও পবিত্রতা অর্জনের নাম মা’রেফাত, উহা অর্জনের ক্ষেত্রে যে শয়তানী শক্তি মানুষকে ধোকা দেয় উক্ত ধোকা থেকে বাঁচার জন্য যে এলেম বা জ্ঞানার্জন করতে হয় উহাই “তাসাউফ” এবং এ জ্ঞানের অধিকারীকে ফারসী ভাষায় পীর আরবী ভাষায় মুর্শিদ বা শায়খ বলা হয়।
ইলমে তাসাউফ অনুশীলন করা প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তির জন্য অবশ্যই কর্তব্য শুধু কুরআন-হাদীস পড়ে উক্ত বিষয়ে পরিপক্ক হওয়া সম্ভব নয়। কেননা মিস্ত্রির কাছে শিক্ষা না নিয়ে কেউ মিস্ত্রি হতে পারে না। দর্জি থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে কেউ একটি সুই পর্যন্ত চালাতে পারবে না। গাড়ী চালাতে হলে অভিজ্ঞ চালকের নিকট প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করে কেউ দক্ষ চালক হতে পারে না। এটাই হলো মাধ্যম অবলম্বনকরা । অতএব আল্লাহ ও রাসূলের নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্য ইলমে তাসাউফ বা মা’রেফাত শিক্ষা করতে হলে তাসাউফ বা মারেফতবিদ পীর মুর্র্শিদ বা শায়খের ছোহবত ও তালিম গ্রহণ করা ব্যতিত সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন- হে ঈমানদারগন! তোমরা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় কর এবং তাঁর নৈকট্য লাভের জন্য অসীলা খোঁজ কর। (সূরা মায়েদা- আয়াত নং৩৫)
উক্ত আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যায় তাফসীরে রুহুল বায়ানে এসেছে- আয়াতে কারীমা দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে যে, শরীয়তে অসীলা খোঁজ করার নির্দেশ রয়েছে এবং উহার বিশেষ প্রয়োজন ও আছে। কেননা অসীলা ব্যতীত সরাসরি আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভ করা সম্ভব নয়, আর ওলামায়ে হক্কানী এবং ত্বরীকার পীরগণই এ অসীলা, যারা আসমানী ইলম এবং রুহানী হেকমাতের তালীম প্রদান করে থাকেন। যদিও আল্লাহ তায়ালার ইবাদত স্বকীয়ভাবে মুক্তি ও নাজাতের কারণ তথাপিও কামেল পীরের তা’লীম এবং ছোহবাতের বিশেষ স্থান রয়েছে। যার ফলে শয়তানের কঠিন ধোঁকা থেকে নিজেকে রক্ষা করা সহজ হয়ে যায়। এ বিষয়ের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে গাউছেপাক বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রা:) তদীয় “সিররুল আসরার” নামক কিতাবে লিখেছেন- অন্তরকে সঞ্জীবিত করে তোলার উদ্দেশ্যে মুর্শিদে কামেল অনুসন্ধান করা ফরজ।
পবিত্র কোরআনে আরও বর্নিত আছে- “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয়কর এবং সত্যবাদীগণের সঙ্গী হও।” (সুরা তাওবা, আয়াত নং-১১৯) ।
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, সত্যবাদীগণের অনুসরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং তাদের থেকে পৃথক থাকতে নিষেধ করা হয়েছে। অতএব كونوا مع الصادقين এর মমার্থ হল তোমরা সত্যবাদীদের সাথে থাক। অর্থাৎ হক্কানী পীর মুর্শিদ বা শায়েখের নিকট বয়াত গ্রহণকর। তাউতো মাওলানা রুমী (রহ.) বলেন-
গরতু খাহী হাম্নশীনি বা-খোদা
গোনশীনি দ্র হুজুরে আউলিয়া
অর্থাৎ- “তুমি যদি খোদার সাথে বসতে চাও তাহলে আউলিয়ায়ে কেরামের দরবারে বস”।

প্রশ্ন: মা’রেফাত বলতে কি বুঝায়? মারেফাতের জ্ঞান লাভ করা আবশ্যক কিনা? জানিয়ে বাধিত করিবেন।
মুহাম্মদ মাসউদুর রহমান, (বি.এ. অনার্স), ঢাকা কলেজ, ঢাকা।
উত্তর: মা’রেফাত শব্দটি আরবী عرف (উরফ) শব্দ থেকে উৎকলিত শাব্দিক অর্থ- পরিচিতি চেনা-জানা, কোন বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করা।
পারিভাষিক অর্থে- পরিচিতি, জানা-শুনা ও নিজের অভিজ্ঞতা দ্বারা যে বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করা হয় তাকে মা’রেফাত বলে। ত্বরীকত বা তাসাউফ শাস্ত্র মতে জগত সমূহের সৃষ্টির পরম সত্ত্বা মহান আল্লাহ তায়ালা ও তার সৃষ্টি জগতের গুপ্তভেদ এবং আপন সত্ত্বাকে জানার নামই হল মা’রেফাত।
আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে যার জ্ঞান যত বেশী তার ঈমান তত শক্তিশালী। কেননা মারেফাতের নূর দ্বারা ঈমান সুসজ্জ্বিত হয়। মা’রেফাত হল ক্বলব নিসৃতঃ জ্ঞান। এ জ্ঞানের সম্পূর্ণ বিকাশ ক্বলবের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। আর ক্বলব নিসৃত জ্ঞানের পরিধি বিশাল। ফলে মা’রেফাত হল একমাত্র অন্তরের কাজ। হাদীস শরীফে রাসুলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেন- আমি আল্লাহ তায়ালাকে তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি জানি ও চিনি। আর নিশ্চয়ই মা’রেফাত ক্বলবের কাজ। কারণ, আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, তিনি তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন সে সমস্ত বিষয়ে যা তোমাদের ক্বলব সমূহ উপার্জন করেছে। (বুখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৭)
উল্লেখিত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হল যে, মারেফাতের স্থান হল ক্বলব এবং ক্বলবই মারেফাতের নূরে নূরান্বিত হয়ে থাকে।




ক্বাসিদায়ে গাউসিয়া
মাহবুবে সোবহানী কুতুবে রাব্বানী পীরানে পীর দস্তগীর গাউসে আযম হযরত শেখ সাইয়্যেদ মহিউদ্দীন আবদুল কাদের জীলানী রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু এর রচনাকৃত।

সংগ্রহে: শেখ আহসান হাবিব সোবহানী (কাওসাইন)
পীরে ত্বরিকত, সহকারি সদস্য সচিব, শাহপুর দরবার শরীফ।


বে হেজাবানা দারা আজ দারেকা শানাএমা
কে কাসে নিস্তে বজুজ দারদে তু দার খানাএমা।।
বেপরদা হইয়া দরজা হইতে ঘরে আস কারণ, তোমার দরদ ব্যতিত আমার ঘরে কেহই নাই।

গরবিয়ায়ি বাস্রে তুরবাতে বিরানাএমা
বিনি আজ খুনে জিগার আবে শুদা খানাএমা।।
তুমি যদি আমার বিরান কবরে মাথার দিকে আস, দেখিবে আমার কলিজার রক্তে কবর ভিজিয়া গিয়াছে।

ফেতনা আঙ্গিযে মাশুকাকুলে মিশকিঁ মাকুশা
তাব জিঞ্জিরে নাদারদ্ দিল দিওয়ানাএমা।।
অনর্থক ঝগড়া করিও না, সুগন্ধি কাকুলের ন্যায় ফুটিয়া যাইও না আমার পাগলা দিলে বেড়ি সহ্য হয়না।

মোরগে বাগে মালাকুতিম দরীঁ দায়রে খারাব
মিশাওয়াদ নূরে তাজাল্লায়ে খোদা দানাএমা।।
এই পরিত্যক্ত কবরে আমি বেহেস্তের বাগানের পাখি এবং খোদার নুরের তাজাল্লিই আমার খোরাক।।

বা আহাদ দর লহদ তঙ্গ বগুইম কেহ্ দুস্ত
আশনাইম তুয়ি গায়র তু বেগানাএমা।।
আল্লাহ্ তায়ালার সহিত ছোট কবরে থাকিয়া বলিব, হে দোস্ত, তুমি আপন এবং অন্য সকল পর।

গার নাকিরা ইয়াদ পুরসদ কেহ্ বাগু রব তু কিস্ত গোইয়াম আঁকসে কেহ্ রোবুদাইন দিল দিওয়ানাএমা।।
যদি নকির আসিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করে তোমার প্রভু কে? তখন বলিব ঐ ব্যক্তি (আল্লাহ্) যিনি এই পাগলের দিল নিয়া গিয়াছেন।
শোকর লিল্লাহ্ কেহ্ নামরদায়েম ও রাসিদায়েম বদুস্ত
আফরিন বাদ বরিন হামতু মারদানাএমা।।
শোকর খোদা, আমি মরি নাই দুস্তের নিকট ফিরিয়া গিয়াছি। আমার বিরত্বের জন্য ধন্যবাদ।

মহি বর শাময়ে’ তাজাল্লায়ে জামালশ মি সুখ্ত
দুস্ত মিগুফত যেহি হামতু মারদানাএমা।।
মহি আল্লাহ্র তাজাল্লির বাতির আগুনে জ্বলিতেছে, দুস্ত (আল্লাহ) বলিলেন, শাবাশ, উত্তম কাজ করিয়া আসিয়াছ।

সূত্র: দিওয়ানে গওছিয়া, অনুবাদক- সৈয়দ এ. বি. মাহমুদ হুসেন, প্রধান বিচারপতি, বাংলাদেশ। প্রকাশিকা- সৈয়দা মালেকা বেগম, ৫৭, শাহ্ সাহেব লেন; ঢাকা-১। প্রকাশকাল- রবিউল আউয়াল, ১৩৯৬ হিজরী।








No comments:

Post a Comment